ঢাকা শুক্রবার, ২৫ এপ্রিল, ২০২৫, ১২ বৈশাখ ১৪৩২

ইতিহাসের সর্বনিম্ন অবস্থানে বেসরকারি বিনিয়োগ

দৈনিক নতুন সংবাদ | নিজস্ব প্রতিবেদক  এপ্রিল ১০, ২০২৫, ১২:৪৭ এএম ইতিহাসের সর্বনিম্ন অবস্থানে বেসরকারি বিনিয়োগ

গত দেড় দশকের মধ্যে ফেব্রুয়ারিতে সর্বনিম্ন অবস্থানে নেমেছে দেশের বেসরকারি খাতের বিনিয়োগ। এর অর্থ হচ্ছে, অর্থনীতির প্রাণচাঞ্চল্য কমে গেছে। সর্বোচ্চ পর্যায়ে সংকুচিত হয়েছে কর্মসংস্থানের সুযোগ। কিন্তু আরেকদিকে ভালো ফল এসেছে। সহনীয় হয়েছে দ্রব্যমূল্য। 

বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাবে, ফেব্রুয়ারি শেষে বেসরকারি খাতে ব্যাংকগুলোর বিতরণ করা মোট ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১৬ লাখ ৮৪ হাজার কোটি টাকা। এই অঙ্ক গত বছরের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত বিতরণ করা ঋণের চেয়ে ৬ দশমিক ৮২ শতাংশ বেশি। ২০২৪ সালের ফেব্রুয়ারি শেষে ব্যাংকগুলোর বিতরণ করা মোট ঋণের পরিমাণ ছিল ১৫ লাখ ৭৭ হাজার কোটি টাকা। যেকোনো দেশে বিনিয়োগ বৃদ্ধির অন্যতম প্রধান নিয়ামক বেসরকারি খাতে ঋণপ্রবাহ।

বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রকাশিত গত ১৫ বছরের তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণে দেখা গেছে, ৭ শতাংশের নিচে কখনো বেসরকারি খাতের বিনিয়োগ প্রবৃদ্ধি নামেনি। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, বাংলাদেশের ইতিহাসে বেসরকারি খাতের ঋণে এত কম প্রবৃদ্ধি কখনো হয়নি। 

চলতি বছরের জানুয়ারিতে এই খাতে ঋণের প্রবৃদ্ধি ছিল ৭ দশমিক ১৫ শতাংশ। ফেব্রুয়ারির আগে এটিই ছিল সর্বনিম্ন প্রবৃদ্ধি। তখন বিতরণকৃত ঋণের পরিমাণ ছিল ১৬ লাখ ৮০ হাজার ১১০ কোটি টাকা। এর আগে গত বছরের ডিসেম্বরে ৭ দশমিক ২৮ শতাংশ, নভেম্বরে ৭ দশমিক ৬৬ শতাংশ ছিল বেসরকারি খাতে ঋণের প্রবৃদ্ধি। 

গত ১০ ফেব্রুয়ারি ঘোষিত ২০২৪-২৫ অর্থ বছরের দ্বিতীয়ার্ধের (জানুয়ারি-জুন) মুদ্রানীতিতে বেসরকারি ঋণের প্রবৃদ্ধির লক্ষ্য ধরা আছে ৯ দশমিক ৮ শতাংশ। সে হিসাবে লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ২ দশমিক ৯৮ শতাংশীয় পয়েন্ট কম হয়েছে প্রবৃদ্ধি।

বিনিয়োগ মানেই অর্থনীতিতে চাঞ্চল্য, বিনিয়োগ মানেই নতুন কর্মসংস্থানের সুযোগ। এসব মিলিয়ে বিনিয়োগ যে কোনও দেশের অর্থনীতিকে দেয় স্বস্তি। এই সূত্রে বাংলাদেশ এখন আছে অস্বস্তিতে।

এ প্রসঙ্গে অর্থনীতি বিশ্লেষক মো. মাজেদুল হক বলেন, বেসরকারি বিনিয়োগ কমে যাওয়ার কারণ হচ্ছে মূল্যস্ফীতি কমাতে গিয়ে ঋণের সুদহার বাড়ানো হয়েছে। অপরদিকে সরকারি ঋণ বেড়ে গেছে। এর প্রভাব অর্থনীতিতে ভালো না। এতে উৎপাদন ও কর্মসংস্থান কমে যায়। 

বাংলাদেশের অর্থনীতি বর্তমানে স্থবিরতার দিকে যাচ্ছে উল্লেখ করে মাজেদুল হক বলেন, একটি অর্থনীতিতে উচ্চ মূল্যস্ফীতি, উচ্চ বেকারত্ব ও কম প্রবৃদ্ধির সমন্বয় ঘটলে তাকে স্থবির অর্থনীতি বলে। আমাদের এই তিনটিরই সমন্বয় ঘটে গেছে। 

শুধু পলিসি রেট বাড়িয়ে উচ্চ মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ সম্ভব নয় উল্লেখ করে এই অর্থনীতিবিদ বলেন, মূল্যস্ফীতি কমাতে হলে মুদ্রানীতি, রাজস্ব নীতি ও বাজার নীতি নিয়ে সমন্বিতভাবে কাজ করতে হবে। 

ব্যবসায়ী নেতারা বলছেন, নতুন বিনিয়োগ না হলে কর্মসংস্থানের সুযোগও বাড়বে না। ফলে অর্থনীতিতে দীর্ঘমেয়াদে নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে।

বিনিয়োগ পরিস্থিতি বিশ্লেষণে দেখা গেছে, আগের চেয়ে বিনিয়োগ এখন অনেক বেশি দামি হয়ে গেছে। একদিকে বেড়েছে ডলারের দাম, অন্যদিকে ব্যাংক সুদহারও চড়া। এ অবস্থায় নতুন বিনিয়োগ করতে গেলে আগের চেয়ে অনেক বেশি অর্থ বিনিয়োগ করতে হবে। আবার উচ্চ মূল্যস্ফীতির চাপে বাজারে পণ্যের চাহিদাও কমে গেছে। সব মিলিয়ে বিনিয়োগের জন্য এ সময়টাকে মোটেই অনুকূল মনে করছেন না ব্যবসায়ীরা।

করোনা মহামারির সময় ২০২০ সালের মে মাসে বেসরকারি খাতে ঋণপ্রবাহের প্রবৃদ্ধি ৭ দশমিক ৫৫ শতাংশে নেমে এসেছিল।

চলতি অর্থ বছরের ষষ্ঠ মাস ডিসেম্বরে এই হার ছিল ৭ দশমিক ২৮ শতাংশ; নভেম্বরে ছিল ৭ দশমিক ৬৬ শতাংশ; অক্টোবরে ছিল ৮ দশমিক ৩০ শতাংশ; সেপ্টেম্বরে ছিল ৯ দশমিক ২০ শতাংশ; অক্টোবরে ছিল ৮ দশমিক ৩০ শতাংশ এবং সেপ্টেম্বরে ছিল ৯ দশমিক ২০ শতাংশ।

চলতি অর্থ বছরের দ্বিতীয় মাস আগস্টে বেসরকারি খাতে ঋণপ্রবাহের প্রবৃদ্ধি হয় ৯ দশমিক ৮৬ শতাংশ; প্রথম মাস জুলাইয়ে এই প্রবৃদ্ধি ছিল দুই অঙ্কের ঘরে (ডাবল ডিজিট) ১০ দশমিক ১৩ শতাংশ।

রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পর ব্যবসার পরিবেশে অনিশ্চয়তা আর ব্যাংক ঋণে উচ্চ সুদহারের প্রভাবে গত কয়েক মাস বেসরকারি খাতে ঋণপ্রবাহের প্রবৃদ্ধি কমছে বলে জানিয়েছেন অর্থনীতিবিদ ও ব্যাংকাররা।

দেখে গেছে, মূল্যস্ফীতির লাগাম টানতে নীতি সুদহার বাড়িয়েই চলেছে বাংলাদেশ ব্যাংক; উঠেছে ১০ শতাংশে।

ব্যাংক ঋণের সুদের হার ১৫ শতাংশ ছাড়িয়ে গেছে। রাজনৈতিক অনিশ্চয়তায় ব্যবসায়ী-উদ্যোক্তারা নতুন বিনিয়োগ করছেন না। ক্ষমতার পট পরিবর্তনের আট মাস পার হতে চলেছে। এখনও দেশে স্বাভাবিক পরিস্থিতি ফিরে আসেনি। আইন-শৃংখলা পরিস্থিতির চরম অবনতি হয়েছে; দিন যতো যাচ্ছে, পরিস্থিতি ততোই খারাপের দিকে যাচ্ছে। তবে মূল্যস্ফীতি নিম্মমূখী হয়েছে।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) সবশেষ তথ্যে দেখা যায়, ফেব্রুয়ারিতে পয়েন্ট টু পয়েন্ট ভিত্তিতে (মাসওয়ারি বা মাসভিত্তিক) দেশে সার্বিক মূল্যস্ফীতি কমে ৯ দশমিক ৩২ শতাংশে নেমে এসেছে। চার মাস পর জানুয়ারিতে এই সূচক এক অঙ্কের ঘরে (সিঙ্গেল ডিজিট), ৯ দশমিক ৯৪ শতাংশে নামে।

গত বছরের জুন মাসে দেশে সার্বিক মূল্যস্ফীতির হার ছিল ৯ দশমিক ৭২ শতাংশ। জুলাইয়ে তা বেড়ে ১১ দশমিক ৬৬ শতাংশে ওঠে। আগস্টে তা কিছুটা কমে হয় ১০ দশমিক ৪৯ শতাংশ। পরের মাস সেপ্টেম্বরে তা আরও কমে ৯ দশমিক ৯২ শতাংশ হয়।

এরপর থেকে তা ১০ শতাংশের উপরেই অবস্থান করছিল। নতুন বছরের প্রথম মাস জানুয়ারিতে এই সূচক ৯ দশমিক ৯৪ শতাংশে নেমে এসেছে।

Side banner