Daily Natun Sangbad
Bongosoft Ltd.
ঢাকা বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল, ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

ডেঙ্গুর চ্যালেঞ্জ মশার আচরণ : ডা. আব্দুল্লাহ

দৈনিক নতুন সংবাদ | নিজস্ব প্রতিবেদক : ডিসেম্বর ২২, ২০২২, ০৪:৩৬ এএম ডেঙ্গুর  চ্যালেঞ্জ মশার আচরণ : ডা. আব্দুল্লাহ

ইমেরিটাস অধ্যাপক ও প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত চিকিৎসক ডা. এ বি এম আব্দুল্লাহ বলেন, এডিস মশার কামড় এড়িয়ে চলাই ডেঙ্গু প্রতিরোধের প্রধান উপায়। তাই মশার আবাসস্থল ধ্বংস করে মশার বংশবিস্তার প্রতিরোধ করতে হবে। তিনি আরও বলেন, মশার আচরণগত পরিবর্তন ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণের বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাড়িয়েছে। এডিস মশা বাহিত ডেঙ্গু ভাইরাস জনিত গ্রীষ্মমন্ডলীয় রোগ হলেও বর্তমান প্রেক্ষাপটে মনে হচ্ছে এই রোগটি বছরভরেই থাকবে। তাই এই রোগের মেডিসিন আবিস্কার না হওয়া পর্যন্ত রোগটি হতে নিস্তার নেই মনে হচ্ছে। এখন থেকেই আমাদের সবাইকে সচেতন থাকতে হবে।

ডা. এ বি এম আব্দুল্লাহ আরও বলেন, সম্প্রতি বিভিন্ন জার্নালে প্রকাশিত তথ্য উপাত্ত থেকে জানা গেছে ডেঙ্গু জ্বর প্রতিরোধী টিকা কয়েকটি দেশে অনুমোদিত হয়েছে।  তবে এই টিকা শুধু একবার সংক্রমিত হয়েছে এমন ব্যক্তির ক্ষেত্রে কার্যকর। তবে সবচেয়ে বড় কথা এডিস মশার কামড় এড়িয়ে চলাই ডেঙ্গু প্রতিরোধের প্রধান উপায়। এডিস মশার বংশ বিস্তারের উপযোগী বিভিন্ন আধারে, অর্থাৎ কাপ, টব, টায়ার, ডাবের খোলস, গর্ত, ছাদ ইত্যাদিতে আটকে থাকা পানি জমে থাকতে দেওয়া যাবেনা, অপসারণ করতে হবে।

শরীরের বেশির ভাগ অংশ ঢেকে রাখে এমন পোশাক পরতে হবে। ডেঙ্গু জ্বর হলে পরিপূর্ণ বিশ্রাম নিতে হবে এবং বেশি করে তরল খাবারসহ ডাব খেতে হবে। জ্বর কমাতে প্যারাসিটামল দেওয়া হয়। প্রায়ই রোগীর শিরায় স্যালাইন দিতে হতে পারে। ডেঙ্গু জ্বর হলে কোন ধরনের এন্টিবায়োটিক ও ননস্টেরয়েডাল প্রদাহপ্রশমী ওষুধ সেবন করা যাবে না।

ডা. এ বি এম আব্দুল্লাহ বলেন,  দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তীকালে ডেঙ্গু একটি বৈশ্বিক আপদে পরিণত হয়েছে। এশিয়া, দক্ষিণ আমেরিকা ও অন্যান্য মহাদেশের ১১০টির অধিক দেশে ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব হয়। প্রতি বছর পাঁচ থেকে পঞ্চাশ কোটি মানুষ ডেঙ্গুতে সংক্রমিত হয় এবং তাদের মাঝে দশ থেকে বিশ হাজারের মতো মারা যায়।

ডা. আব্দুল্লাহ বলেন, বাংলাদেশে সরকারি হিসাবে এ বছর ডিসেম্বর ১৯ তারিখ পর্যন্ত ৬১ হাজারের বেশি মানুষ ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে। চিকিৎসাসেবা নিয়ে বাড়ি ফিরেছে ৬০ হাজারের অধিক। তবে  ডেঙ্গু নামটি কোথা থেকে এসেছে, তা পরিষ্কার নয়। কিন্তু ধারণা করা হয় যে, আফ্রিকার সোয়াহিলি ভাষার প্রবাদ ‘কা-ডিঙ্গা পেপো, থেকে  ডেঙ্গু নামটি এসেছে।

এ নিয়ে বিভিন্ন গবেষণায় বিষয়টি ব্যাখ্যা করা হয়েছে। নেদারল্যান্ডস এর ডেঙ্গু নিয়ে গবেষক ডি. এ. ব্লেইজিস-এর মতে, সোয়াহিলি ভাষার ডিঙ্গা শব্দটি স্প্যানিশ শব্দ  ডেঙ্গু থেকে আসতে পারে, যার মানে হলো সতর্ক থাকা। একজন ব্যক্তির হাড়ে ব্যথা থেকে সতর্ক থাকা ব্যাখ্যা করতে বোঝানো হয়, যা ডেঙ্গু জ্বরের সময় হয়ে থাকে। আরেকটি ধারণা চালু আছে যে, ওয়েস্ট ইন্ডিজ থেকে যে দাসরা এই জ্বরে আক্রান্ত হয়ে অনেকটা ত্যাড়াব্যাকা হয়ে হাঁটতো বলে তাদের ডাকা হতো ‘ডান্ডি ফিভার, বলে, সেখান থেকে  ডেঙ্গু নামটি এসেছে। তিনি বলেন, ডেঙ্গু একটি প্রাচীন রোগ। এই রোগের প্রথম উল্লেখ পাওয়া গেছে চীনের চিকিৎসা সংক্রান্ত নথিপত্রে। সেখান থেকে জানা যায়, চীনে এই রোগটি ৯৯২ খৃষ্টাব্দে শনাক্ত করা হয়েছিল। কোন কোন গবেষক অবশ্য দাবি করেন, চীনে জিন রাজতন্ত্রের সময়কার (২৬৫-৪২০ খৃষ্টপূর্ব) নথিপত্রে এই রোগের উল্লেখ পাওয়া যায়। সেখানে অবশ্য একে উড়ন্ত পোকামাকড়ের কারণে বিষাক্ত পানির রোগ বলে বর্ণনা করা হয়েছে। তবে এই দাবি নিয়ে বিতর্ক রয়েছে।

যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল লাইব্রেরি অফ মেডিসিন বলছে, আঠারো এবং উনিশ শতকের দিকে বিশ্বব্যাপী যখন জাহাজ শিল্পের বিকাশ ঘটতে থাকে, বন্দর নগরীগুলো গড়ে উঠতে শুরু করে এবং শহর এলাকা তৈরি হয়, তখন এই ডেঙ্গুর জীবাণুবাহী ভেক্টর এবং এডিস ইজিপ্টির জন্য আদর্শ পরিবেশ তৈরি হয়।

এই জ্বরকে শনাক্ত এবং ডেঙ্গু জ্বর বলে নামকরণ করা হয় ১৭৭৯ সালে। এরপরের বছর প্রায় একই সময়ে এশিয়া, আফ্রিকা, উত্তর আমেরিকায় ব্যাপকভাবে দেখা যায়। শরীরে ব্যথার কারণে তখন একে  ‘হাড়ভাঙ্গা জ্বর’ বলেও ডাকা হতো। বিংশ শতকের প্রথমভাগে ডেঙ্গুর ভাইরাস উৎস ও সংক্রমণ বিশদভাবে জানা যায়। মশক নিধনই বর্তমানে ডেঙ্গু প্রতিরোধের প্রধান উপায়।

তিনি বলেন, সরাসরি ডেঙ্গু ভাইরাসকে লক্ষ্য করে ওষুধ উদ্ভাবনের গবেষণা চলমান রয়েছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বিশটি অবহেলিত গ্রীষ্মমন্ডলীয় রোগের একটি হিসেবে ডেঙ্গু চিহ্নিত করেছে। তবে চলতি বছর যেহারে ডেঙ্গু রোগী পাওয়া গেছে, মনে হচ্ছে সারা বছরেই কমবেশি থাকবে। এজন্য সবারই আরও বেশি সচেতন হতে হবে। কেননা পৃথিবীতে প্রতি বছর ৩৯০ মিলিয়ন ডেঙ্গু ভাইরাস সংক্রমণ হয়, যার মধ্যে ৯৬ মিলিয়ন ক্লিনিক্যালি তীব্রতাসহ প্রকাশ পায়। পৃথিবীর ১২৯টি দেশে ডেঙ্গু সংক্রমণের ঝুঁকি থাকলেও এর ৭০ ভাগ এশিয়ায়।

বাংলাদেশে ২০০০ সালের পর থেকে প্রতিবছরই কমবেশি ডেঙ্গু হয়েছে, তবে এই বছর আক্রান্ত এবং মৃত্যু সংখ্যা আশঙ্কাজনক পর্যায়ে দাড়িঁয়েছে। নভেম্বরে এসেও আক্রান্ত ও মৃত্যুর সংখ্যা বেড়েই চলেছে। তবে ডিসেম্বর শেষ তার পরে-ও  কোনোভাবেই যেন মশার সাথে পেরে উঠছে না মানুষ। পৃথিবীতে সাড়ে তিন হাজারেরও অধিক প্রজাতির মশা শনাক্ত করা হয়েছে। আর বাংলাদেশে এখন পর্যন্ত লিপিবদ্ধ করা হয়েছে ১২৩ প্রজাতির মশা।

মশা অত্যন্ত ক্ষুদ্র প্রাণী হলেও অত্যন্ত বুদ্ধিমান। ক্ষুদ্র এই প্রাণীটি যেকোনো পরিবর্তিত ও প্রতিকূল পরিবেশে নিজেকে পরিবর্তন করে খাপ খাইয়ে নিতে সক্ষম। আর যদি সেটি  ডেঙ্গুর প্রধান বাহক এডিস ইজিপ্টি হয় তাহলে তো কোনো কথাই নেই।

সিঙ্গাপুরের মতো পৃথিবীর অনেক পরিচ্ছন্ন শহরেও এডিস ইজিপ্টি দুর্দান্ত প্রতাপের সাথে তার অবস্থান শক্ত করে সফলভাবে ডেঙ্গু ছড়িয়ে যাচ্ছে। বর্তমানে সারা পৃথিবীতে ডেঙ্গু রোগ বিস্তার এবং এর নিয়ন্ত্রণ নিয়ে কথাবার্তা চলছিলো। তবে যখন ডেঙ্গু ভাইরাস বহনকারী মশা কাউকে কামড়ায়, মশার লালার মাধ্যমে ভাইরাস ত্বকের ভিতর প্রবেশ করে। এটি বাসস্থান পাকা করে নেয় এবং শ্বেত রক্তকোষে প্রবেশ করে, এবং যখন কোষগুলি শরীরের সর্বত্র চলাচল করে তখন সেগুলির ভিতরে এই ভাইরাস প্রজননকার্য চালিয়ে যায়। এর প্রতিক্রিয়ায় শ্বেত রক্তকোষগুলি বহুসংখ্যক সিগন্যালিং প্রোটিন তৈরি করে, ইন্টারফেরন, যা অনেকগুলি উপসর্গের জন্য দায়ী, যেমন জ্বর, ফ্লু-এর মত উপসর্গ, এবং প্রচন্ড যন্ত্রণা।

প্রবল সংক্রমণে, শরীরের ভিতরে ভাইরাসের উৎপাদন অত্যধিক বৃদ্ধি পায়, এবং অনেক বেশি প্রত্যঙ্গ ( যেমন যকৃত এবং অস্থিমজ্জা) ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে, এবং রক্তস্রোত থেকে তরল ক্ষুদ্র রক্তনালিগুলির দেওয়াল থেকে শরীরগহ্বরে চুঁইয়ে পড়ে। ফলে, রক্তনালিগুলিতে কম রক্ত সংবহিত হয় এবং রক্তচাপ এত বেশি কমে যায়।  তাই অনেক সময়  রক্তের প্রয়োজন হয় । কারণ উপরন্তু অস্থিমজ্জা কাজ না করায় অনুচক্রিকা বা প্লেটলেটসের সংখ্যা কমে যায় যা কার্যকরী রক্ততঞ্চনের জন্য দরকারি তাই  অনেক সময় রোগীর যাতে সমস্যা না এজন্য রক্তের প্রয়োজন  হলে চিকিৎসক রোগীকে  পরীক্ষা নিরীক্ষা যদি মনে করেন সেই ক্ষেত্রে রক্ত দেওয়া হয়। তবে ডাঃ আবদুল্লাহ বলেন,  ডেঙ্গু জ্বরের কোন নির্দিষ্ট চিকিৎসা নেই। ১৯৬০ থেকে ২০১০-এর মধ্যে ডেঙ্গুর ঘটনা ৩০ গুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। এই বৃদ্ধির কারণ হিসাবে মনে করা হয় শহরের  জনসংখ্যা বৃদ্ধি, বৈশ্বিক উষ্ণায়ন-এর সম্মিলন। ভৌগোলিক বিভাজন অনুযায়ী বিষুবরেখার চারপাশে মোট দুই দশমিক পাঁচ  বিলিয়ন জনসংখ্যার ৭০ শতাংশই এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে মহামারীপ্রবণ এলাকায় বসবাস করে। আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রে, মহামারীপ্রবণ এলাকা থেকে জ্বর নিয়ে ফিরে এসেছে এমন লোকেদের মধ্যে ডেঙ্গু সংক্রমণের হার  দুই  দশমিক ৯ থেকে ৮ শতাংশ এবং এই গোষ্ঠীতে ম্যালেরিয়ার পর এটি দ্বিতীয় সবচেয়ে সাধারণ সংক্রমণ হিসাবে নিরূপিত হয়েছে।

২০০৩ পর্যন্ত, ডেঙ্গুকে সম্ভাব্য জৈবসন্ত্রাসের চর হিসাবে ধরা হত, কিন্তু পরবর্তী রিপোর্টগুলিতে এই বিভাজন অপসারিত হয় কারণ দেখা যায় এটি অন্তরিত হওয়া খুবই কঠিন এবং এর কারণে তুলনামূলকভাবে স্বল্প অনুপাতে লোকেদের হেমারেজিক ফিভার হয়।বর্তনানে ডেঙ্গু প্রবণ এলাকাগুলিতে গ্রাম, শহর ও নগরের সম্প্রসারণ, এবং মানুষের চলাচল মহামারী বৃদ্ধি ও ভাইরাস ছড়ানোর জন্য দায়ি। যে কোন ভাইরাস প্রতিরোধে চাই জনসচেতনতাসহ রাষ্ট্রের প্রতিটি অধিদপ্তর অফিস সংস্থাকে, জনপ্রতিনিধিকে এগিয়ে আসতে হবে।  একা স্বাস্থ্য মন্ত্রনালয় স্বাস্থ্য অধিদপ্তরসহ সিটি কর্পোরেশনের পক্ষে প্রতিরোধ বা নিরাময় করা সমভব না বলে জানালেন তিনি। ###

Side banner