ঢাকা মঙ্গলবার, ১৬ সেপ্টেম্বর, ২০২৫, ৩১ ভাদ্র ১৪৩২

নদীর গর্ভে শৈলকুপার বড়ুরিয়া, বিলীন হচ্ছে ঘরবাড়ি-ভিটেমাটি

দৈনিক নতুন সংবাদ সেপ্টেম্বর ১৫, ২০২৫, ১১:৩৮ পিএম নদীর গর্ভে শৈলকুপার বড়ুরিয়া, বিলীন হচ্ছে ঘরবাড়ি-ভিটেমাটি

গ্রামের পর গ্রাম জুড়ে গড়াই নদীর ভয়াল ভাঙন। গ্রামবাসীর কপালে চিন্তার ভাঁজ। কখন যেন সর্বনাশী গড়াই নদী কেড়ে নেয় শেষ সম্বল-ভিটেবাড়ি।

সাম্প্রতিক সময়ে তীব্র নদীভাঙনে ঝিনাইদহের শৈলকুপা উপজেলার একাধিক গ্রাম বিলীন হওয়ার পথে। ইতোমধ্যেই অনেকে ফসলি জমি হারিয়ে নিঃস্ব হয়ে গেছেন। প্রায় প্রতি বছরই ভিটেমাটি ও জমিজমা মানচিত্র থেকে হারিয়ে যাচ্ছে। বর্তমানে নতুন করে ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে সারুটিয়া ইউনিয়নের বড়ুরিয়া, কৃষ্ণনগর; হাকিমপুর ইউনিয়নের মাদলা; এবং ধলহরাচন্দ্র ইউনিয়নের কাশিনাথপুর, মাজদিয়া ও উলুবাড়িয়া গ্রাম।

প্রায় দুই যুগ ধরে গড়াই নদীর ভাঙনে পরিবর্তিত হয়েছে নদীর গতিপথ। এর মধ্যে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত এলাকা হলো- বড়ুরিয়া, কৃষ্ণনগর, খুলুমবাড়ি, মাদলা, কাশিনাথপুর ও লাঙ্গলবাঁধ। ভিটেবাড়ি ও সহায়-সম্পদ হারিয়ে অনেকে আশ্রয় নিয়েছেন পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) প্রধান সেচ খালের পাশে।

সরেজমিনে ভাঙন এলাকায় গিয়ে দেখা গেছে, মানুষ আতঙ্কে দিন কাটাচ্ছেন। নদীর পানি বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ভাঙনের তীব্রতাও বেড়ে গেছে। পাট, কলা ও মরিচ চাষের জমিসহ ফসলি জমি ভাঙতে শুরু করেছে। পানি উন্নয়ন বোর্ডের ফেলা জিও ব্যাগগুলোও প্রবল স্রোতে ভেসে যাচ্ছে।

অনেকে ইতোমধ্যে ঘরবাড়ি হারিয়ে গ্রাম ছেড়ে অন্যত্র চলে গেছেন। গড়াই নদীর ভাঙনে প্রতিনিয়ত পাল্টে যাচ্ছে গ্রামের মানচিত্র।

শৈলকুপা পানি উন্নয়ন বোর্ডের তথ্য অনুযায়ী, গড়াই নদীর শৈলকুপা অংশে প্রবাহিত দৈর্ঘ্য ২০ কিলোমিটার। এর মধ্যে বড়ুরিয়া গ্রামের ওপর দিয়ে বয়ে গেছে দেড় কিলোমিটার, কৃষ্ণনগর এক কিলোমিটার, গোসাইডাঙ্গা ৫০০ মিটার, মাদলা এলাকায় দেড় কিলোমিটার, মাজদিয়া এক কিলোমিটার এবং লাঙ্গলবাঁধ এলাকায় ৫০০ মিটার ভাঙনপ্রবণ এলাকা রয়েছে। তবে বড়ুরিয়া গ্রামে দেড় কিলোমিটার এলাকাজুড়ে ভাঙন সবচেয়ে তীব্র।

তথ্য অনুযায়ী, গড়াই নদীর ওপারে রয়েছে কুষ্টিয়ার খোকসা উপজেলার গনেশপুর আদর্শ গ্রাম। এপারের জমি ভেঙে ওপারে জেগে ওঠা চরে কুষ্টিয়ার মানুষ শৈলকুপার কাউকে যেতে দেয় না বলে অভিযোগ স্থানীয়দের। তবে এখনও পর্যন্ত ওই চর উদ্ধারেও কেউ কোনো উদ্যোগ নেয়নি।

পানি উন্নয়ন বোর্ডের পক্ষ থেকে ২০১৯ ও ২০২১ সালে একটি ডিপিপি প্রকল্প পরিকল্পনা কমিশনে দাখিল করা হলেও তা এখনও আলোর মুখ দেখেনি।

বর্তমানে গড়াইয়ের ভাঙন রোধে অস্থায়ীভাবে একটি সমীক্ষা প্রকল্পের আওতায় ১৭৫ কেজি ওজনের বালিভর্তি জিও ব্যাগ ফেলা হচ্ছে। ১ মে ২০২৪ থেকে শুরু হওয়া এই প্রকল্প শেষ হবে ২০২৬ সালের জুন মাসে। প্রায় ১৭ কোটি টাকার এই প্রকল্প বাস্তবায়িত হবে চার ধাপে।

বড়ুরিয়া গ্রামের বাসিন্দা জাহাঙ্গীর ইসলাম জানান, তার ১০ বিঘা ফসলি জমি নদীগর্ভে চলে গেছে। নদীভাঙনের যেভাবে তীব্রতা বাড়ছে, তাতে ভিটেবাড়িও রক্ষা করতে পারবেন কি না সেই শঙ্কায় রয়েছেন।

একই গ্রামের খলিলুর রহমান বলেন, ১৯৬২ সাল থেকে গড়াই নদীর ভাঙন শুরু হলেও গত ২০ বছরে তা বহুগুণে বেড়েছে। সিএস রেকর্ড অনুযায়ী, বড়ুরিয়া মৌজায় ব্যক্তিমালিকানাধীন জমির পরিমাণ ছিল ১ হাজার ৪৫৭ বিঘা। খাস জমি ছিল আরও ১৪৩ বিঘা।

বর্তমানে নদীভাঙনের ফলে জমির পরিমাণ কমে গড়ে দাঁড়িয়েছে মাত্র ২৫০ বিঘায়। আগে যেখানে ৭০০ পরিবার বসবাস করতেন, এখন সেখানে আছে মাত্র ২০০ পরিবার। বাকিরা অন্যত্র সরে গেছেন।

সুন্দরী খাতুন নামে এক বাসিন্দা জানান, তাদের পরিবারের প্রায় ৩০ বিঘা জমি ছিল। এখন তা কমে ১০ বিঘায় দাঁড়িয়েছে।

অপর বাসিন্দা মনি মোল্লা বলেন, বড়ুরিয়া গ্রামের প্রায় ১ হাজার ৪০০ বিঘা জমি গড়াইয়ের ভাঙনে কুষ্টিয়ার অংশে চলে গেছে। তিনি আরও জানান, এপাশ থেকে ভেঙে ওপারে চরের জমি জেগেছে। সেসব জমি কুষ্টিয়ার খোকসা উপজেলার লোকজন দখল করে নিয়েছে।

অভিযোগ রয়েছে, প্রশাসনের পক্ষ থেকেও এই জমিগুলো উদ্ধারে কোনও কার্যকর উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে না। ফলে দিন দিন নিঃস্ব হচ্ছেন বড়ুরিয়ার সাধারণ মানুষ।

ঝিনাইদহ পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী রঞ্জন কুমার দাস বলেন, বর্ষার শুরুতে ভাঙন রোধে অস্থায়ী সমীক্ষার আওতায় জিও ব্যাগ ফেলার কাজ চলছে। এই কাজ চলবে ২০২৬ সালের জুন পর্যন্ত। এরপর বরাদ্দ পেলে স্থায়ী কাজ করা হবে। নদীর ওই অংশ নিচু হওয়ায় পানির চাপ বেড়ে পলি সরে গিয়ে ভাঙন দেখা দেয়।

ঝিনাইদহ জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ আব্দুল আওয়াল বলেন, শৈলকুপা অংশ ভেঙে নদীর ওপারে কুষ্টিয়ায় জেগে ওঠা চরের জমি উদ্ধারে উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। শৈলকুপার মানুষ যাতে সেখানে চাষাবাদ করতে পারে, সে বিষয়েও কার্যক্রম চলছে। জেলা প্রশাসন ও সংশ্লিষ্ট দপ্তরের যৌথ বৈঠকের পর সরকারের জরিপ অধিদপ্তরে চিঠি পাঠানো হয়েছে সীমানা নির্ধারণের জন্য। দ্রুতই বিধিসম্মতভাবে নদী পাড়ের সমস্যার সমাধান করা সম্ভব হবে।

Side banner