ঢাকা বৃহস্পতিবার, ০৬ নভেম্বর, ২০২৫, ২২ কার্তিক ১৪৩২

ধান ছেড়ে তেজপাতা চাষে ঝুঁকছেন কাউনিয়ার কৃষক

দৈনিক নতুন সংবাদ অক্টোবর ২, ২০২৫, ০২:২৮ পিএম ধান ছেড়ে তেজপাতা চাষে ঝুঁকছেন কাউনিয়ার কৃষক

কাউনিয়ার টেপামধুপুর ইউনিয়নের একটি গ্রাম বাজেমজকুর। এই গ্রামের প্রতিটি বাড়িতে রয়েছে তেজপাতার বাগান। বাড়ির নারী-পুরুষ নির্বিশেষে নিজেরাই তেজপাতা আবাদ ও পরিচর্যা শেষে বস্তা ভরে তুলে দেন ব্যবসায়ীদের হাতে।

 

এ দৃশ্য শুধু বাজেমজকুর গ্রামেরই নয়। টেপামধুপুর, চৈতারমোড়, রাজিবসহ বিভিন্ন গ্রাম ঘুরে দেখা গেছে, তেজপাতা ঘিরে এমন কর্মব্যস্ততা। প্রচলিত ফসলের জমির পাশাপাশি দেখা মিলছে তেজপাতার বাগান।

রংপুরে এক সময় অনেকে শখ করে বাড়ির আঙিনায় তেজপাতার গাছ রোপণ করতেন পরিবারের চাহিদা মেটানোর জন্য। এখন অবস্থা পাল্টে গেছে। এখন যে দিকে চোখ যায় সেদিকেই তেজপাতার গাছ চোখে পড়ে। ধানচাষে লাভ কম হওয়ায় অনেকেই তেজপাতা চাষে আগ্রহী হয়ে উঠছেন।

জেলার কাউনিয়া উপজেলায় বাণিজ্যিকভাবে উৎপাদিত তেজপাতা দেশের গণ্ডি পেরিয়ে সৌদি আরব, দুবাই, মালয়েশিয়া ও সিঙ্গাপুরসহ ২১টি দেশে যাচ্ছে। ব্যাপক চাহিদা ও বাজারমূল্য ভালো থাকায় এখন উপজেলার বিভিন্ন এলাকায় বাণিজ্যিকভাবে মশলার চাষ হচ্ছে।

উপজেলার রাজীব গ্রামের কৃষক মো. আবু সুফিয়ান জানান, ৬৬ শতক জমিতে ৩৩৩টি তেজপাতা গাছ লাগান তিনি। এতে তার খরচ হয় ৩০ হাজার টাকা। এ পর্যন্ত তিনি আয় করেছেন ২ লাখ টাকা।

একই গ্রামের আশরাফুল ইসলাম আগে যে জমিতে ধান, পাটসহ বিভিন্ন সবজির আবাদ করতেন, এখন সেখানে তেজপাতার বাগান করেছেন।

আশরাফুল জানান, ধান, পাট আবাদের চেয়ে তেজপাতা চাষে পরিশ্রম ও খরচ কম। এছাড়া এটি লাভজনক। একবার চারা রোপণ করলে জীবনের বেশিরভাগ সময় ফলন পাওয়া যায়। তিনি প্রথম বছর ৩ মণ পাতা বিক্রি করতে পারলেও বর্তমানে ১৬ মণ পর্যন্ত বিক্রি করছেন। আগামী মৌসুমে এর চেয়েও বেশি তেজপাতা বিক্রি করতে পারবেন বলে তিনি আশা করছেন।

বাজেমজকুর গ্রামের বেশ কয়েকজন কৃষকের সঙ্গে কথা হলে তারা জানান, ধান চাষে লাভ কম, পরিশ্রম বেশি। উপজেলার অনেক কৃষক এখন ধান চাষ ছেড়ে তেজপাতা চাষে মনোযোগী। তেজপাতা বাগান করতে হলে জমিতে নামমাত্র চাষ দিতে হয়। সেখানে জৈব সার ছিটিয়ে এবং সামান্য পরিমাণে রাসায়নিক সার দিয়ে চারা লাগাতে হয়। এই গাছের পাতা ছাগল-গরু খায় না। একটি চারা রোপণের চার বছর পর থেকে ৫০ বছর পর্যন্ত পাতা পাওয়া যায়।

বর্তমানে প্রতিটি গাছে বছরে ২৫ থেকে ৪০ কেজি করে পাতা পাওয়া যায়। দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে ব্যবসায়ীরা এসে বাগান থেকে কেজিপ্রতি কাঁচা পাতা কিনে নিয়ে যান। এছাড়া চুক্তিতে পুরো বাগানের পাতাও বিক্রি করা যায়। কাউনিয়া উপজেলা থেকে স্কয়ার গ্রুপ, প্রাণ, পুষ্টি, তীর, ইস্পাহানিসহ বিভিন্ন কোম্পানি তেজপাতা কেনে।

পীরগাছার চৈতার মোড় এলাকার পাইকারি ব্যবসায়ী রফিকুল ইসলাম বলেন, কাউনিয়া থেকে প্রতি সপ্তাহে ৩০০ বস্তা তেজপাতা কিনে ঢাকায় পাঠাই। প্রতি কেজি তেজপাতা ১০৮-১১২ টাকা পর্যন্ত বিক্রি করি। ঢাকা থেকে রপ্তানিকারকরা সৌদি আরব, দুবাই. সিঙ্গাপুরসহ বিশ্বের ২১টি দেশে পাঠায়। কাউনিয়ার তেজপাতার মান ভালো থাকায় চাহিদা বেশি। সারা বছরই তেজপাতা বিক্রি হয়।

টেপামধুপুর ইউনিয়নের রাজীব ব্লকের উপসহকারী কৃষি অফিসার মো. আনোয়ার হোসাইন বলেন, টেপামধুপুর ইউনিয়নে ৬০ হেক্টরের বেশি জমিতে তেজপাতা চাষ হয়েছে।

কৃষিবিদ আবিদ করিম মুন্না বলেন, গভীর বেলে দোআঁশ ও দোআঁশ মাটি তেজপাতা চাষের জন্য আদর্শ। চারা লাগানোর ৪-৫ বছর পর থেকে তেজপাতা সংগ্রহ করা যায়। একটি গাছ থেকে শত বছর পর্যন্ত পাতা সংগ্রহ করা যায়।

কাউনিয়া উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা তানিয়া আকতার বলেন, কাউনিয়ার বিভিন্ন গ্রামে কয়েকশ বিঘা জমিতে তেজপাতার বাগান রয়েছে। এসব বাগান থেকে কৃষকেরা প্রতি বছর কয়েক কোটি টাকার পাতা বিক্রি করে থাকেন। অর্থকারী ও মসলাজাতীয় উদ্ভিদ তেজপাতার অনেক ভেষজ গুণ আছে। ভেষজ ওষুধ হিসেবে এটি ব্যবহার করা হয়। এ অঞ্চলের আবহাওয়া তেজপাতা চাষের জন্য উপযোগী। কৃষি অধিদপ্তরের পক্ষ থেকে কৃষকদের অনাবাদি জমি ফেলে না রেখে ধান, পাট, আলুসহ বিভিন্ন সবজি চাষের পাশাপাশি তেজপাতা চাষে উদ্বুদ্ধ করা হচ্ছে। অনেক কৃষক প্রচলিত বিভিন্ন ফসলের পাশাপাশি তেজপাতার বাগান করছেন। কম খরচে বেশি লাভ হওয়ায় চাষিরা এখন তেজপাতার চাষে ঝুঁকছেন।

Side banner