‘আল্লাহ আমার সব কিছু নিয়ে গেছে, সব শেষ হয়ে গেছে, আমি এহন কই যামু? ফসল আবাদ নাই, ঘর নাই, মাছা বাইধি রাখার জায়গা নাই। বাপ-দাদার কষ্টের সব শেষ।’—এভাবেই হাউমাউ করে কাঁদছিলেন শেরপুরের ঝিনাইগাতী উপজেলার খৈলকুড়া এলাকার বিধবা রহিমা বেগম।
গত দুই বছরে তিনবার ভাঙনে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে তার ঘরবাড়ি। এবারও মহারশি নদীর বাঁধ ভেঙে শেষ সম্বলটুকুও কেড়ে নিয়েছে পাহাড়ি ঢল। ভেসে গেছে তার দু’টি ঘর, ফসলি জমি, সামান্য আসবাব। স্বামী মারা গেছেন ২৫ বছর আগে, অন্যের জমিতে চাষাবাদ আর দিনমজুরির আয়ে কোনোমতে সংসার চলতো। কিন্তু বৃহস্পতিবারের (১৮ সেপ্টেম্বর) ঢলের পর পরনের কাপড় ছাড়া কিছুই নেই তার।
টানা কয়েকদিনের ভারি বর্ষণ আর ভারতের মেঘালয় থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলে শেরপুরের চেল্লাখালী, সোমেশ্বরী ও মহারশি নদীর পানি বিপৎসীমার ওপর দিয়ে বয়ে যায়। ১৮ সেপ্টেম্বর দুপুরের দিকে মহারশি নদীর বাঁধ ভেঙে ঝিনাইগাতী উপজেলা সদর বাজার ও অন্তত ১০টি গ্রামের নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়।
খৈলকুড়া বাজার এলাকায় এক মুহূর্তে ভেসে যায় অন্তত ১২ থেকে ১৪টি ঘরবাড়ি। ভেঙে পড়ে বিদ্যুতের খুঁটি, ডুবে যায় দোকানপাট, ভেসে যায় ৫০টিরও বেশি মাছের ঘের। পানির নিচে তলিয়ে গেছে প্রায় ১১৩ হেক্টর রোপা আমনের খেত। এক রাতেই সর্বস্ব হারিয়ে নিঃস্ব হয়ে গেছেন অনেক পরিবার।
ক্ষতিগ্রস্ত স্থানীয় আব্দুল জলিল বলেন, আমার দুই ঘর, গরু, ধানের জমি কিছুই রক্ষা করতে পারলাম না। চোখের সামনে নদীতে সব ভেসে গেল।
বৃদ্ধা রহিমা বেগমও একাধিকবার মূর্ছা যান কান্নার ফাঁকে ফাঁকে। ভাঙা বাঁধের ধারে দাঁড়িয়ে তার আর্তনাদ, ‘এক মুঠো ভাত খাওনের জায়গা নাই, কই যামু?’
এই দুর্যোগে প্রাণ হারিয়েছে দুই শিশু। ঝিনাইগাতীর ডাকাবর এলাকার ইসমাইল (১৭) মহারশি নদীর তামাগাঁও এলাকায় নদীতে গাছ ধরতে গিয়ে নিখোঁজ হন। আর নালিতাবাড়ীর বুরুঙ্গা ব্রিজ এলাকায় ভেসে আসা লাকড়ি ধরতে গিয়ে ডুবে যায় হুমায়ুন (১২)। সে স্থানীয় দুলাল মিয়ার ছেলে এবং বুরুঙ্গা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ৩য় শ্রেণির শিক্ষার্থী। তীব্র স্রোতের কারণে ডুবুরি দলের উদ্ধার কার্যক্রম ব্যাহত হয়। রাত ৮টার দিকে ভেসে ওঠে হুমায়ুনের মরদেহ।
স্থানীয়রা অভিযোগ করেন, ২০২২ সালের ঢলে ব্রিজপাড়ের এই বাঁধ ভেঙে গেলেও সংস্কার হয়নি। তাই এ বছর আবারও একই জায়গায় ভাঙন দেখা দিল। তারা বলেন আমরা বারবার বলেছি কিন্তু পানি উন্নয়ন বোর্ড ব্যবস্থা নেয়নি। আজ সব ভেসে গেছে।
শেরপুর পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. আখিনুজ্জামান বলেন, চেল্লাখালী, মহারশি ও সোমেশ্বরী নদীর পানি হ্রাস পাচ্ছে, তবে ভোগাই নদীর পানি বাড়ছে। নাকুগাঁও পয়েন্টে এটি বিপৎসীমার ৪৫ সেন্টিমিটার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। রাতে এটি বিপৎসীমা অতিক্রম করতে পারে।
ঝিনাইগাতী উপজেলা নির্বাহী অফিসার মো. আশরাফুল আলম রাসেল বলেন, “বন্যা পরিস্থিতি মোকাবিলায় পর্যাপ্ত ত্রাণ ও রেসকিউ টিম প্রস্তুত আছে। ক্ষতিগ্রস্তদের পাশে দাঁড়াতে সর্বোচ্চ চেষ্টা চলছে।
আপনার মতামত লিখুন :