ঢাকা শুক্রবার, ১৫ আগস্ট, ২০২৫, ৩০ শ্রাবণ ১৪৩২

শিক্ষা সংস্কার: প্রেক্ষিত ২০২৪ পরিবর্তন ও আমার ভাবনা

দৈনিক নতুন সংবাদ | ডেক্স রিপোর্টঃ আগস্ট ১৩, ২০২৫, ১০:১৩ এএম শিক্ষা সংস্কার: প্রেক্ষিত ২০২৪ পরিবর্তন ও আমার ভাবনা
আমাদের উচ্চশিক্ষা নিয়ে জাতীয়ভাবে কোনো পরিকল্পনা নেই

আমাদের বর্তমান সরকারপ্রধান একজন অধ্যাপক, জ্ঞানী-গুণী, সর্বজনবিদিত বিশ্ববরেণ্য ব্যক্তিত্ব। তিনি এক বিশেষ পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে রাষ্ট্র পরিচালনার মতো গুরুদায়িত্ব গ্রহণ করেছেন। জনগণ অনেক আশা-স্বপ্ন নিয়ে এ গুরুদায়িত্ব তাঁর ওপর অর্পণ করেছে। কেননা, এত ত্যাগ-তিতিক্ষা ও বহু রক্তস্নাত পথ পেরিয়ে দেশের জনগণ রাষ্ট্রে কিছু গুণগত পরিবর্তন প্রত্যাশা করে। মানুষের এ চাওয়া নতুন কিছু নয়, তবে পূর্বের সব প্রচেষ্টা রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক দুর্বৃত্তায়নের কারণে ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়েছে। এ পটভূমিতে ২০২৪ সালের জুলাইয়ের আন্দোলনপ্রসূত গণ–অভ্যুত্থান দেশের মানুষকে বিশেষত তরুণ ছাত্রশক্তিকে নতুনভাবে ভাবতে ও দেশ গড়ার নবচেতনায় সঞ্চারিত করেছে।

বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ যেভাবে স্বতঃস্ফূর্তভাবে ২০২৪ সালের জুলাই আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেছে, তাতে সে বিশ্বাসের একটি জনভিত্তি প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। এর মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ একটি বিশেষ রূপান্তর প্রক্রিয়ায় প্রবেশ করবে বলে জোরদার প্রত্যাশা তৈরি হয়েছে। এমন বাস্তবতায় অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের হাত ধরে রাষ্ট্রের নানা রূপান্তরের ভাবনা প্রকাশিত হয়েছে। তিনি অনেক ক্ষেত্রেই যথাযথ পদক্ষেপ নিয়েছেন এবং বেশ কয়েকটি সংস্কার কমিশন গঠন করেছেন। তবে, শিক্ষা পরিবারের একজন সদস্য হয়েও কেন যেন শিক্ষাবিষয়ক কোনো সংস্কারের কাজে হাত দেননি, কোনো উদ্যোগও গ্রহণ করেননি! যে জুলাই আন্দোলন বহুলাংশে শিক্ষার্থীদের নেতৃত্বে হয়েছিল, সেই শিক্ষার্থী বা শিক্ষার গুণগত পরিবর্তনের জন্য কোনো পদক্ষেপ আমরা দেখিনি!

আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার কাঠামো পরিবর্তনের সুযোগ অতীতে বহুবার এসেছে। ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধোত্তর সময় যেমন একটি বড় সুযোগ তৈরি করেছিল, তেমনি ১৯৯০ সালের স্বৈরাচারবিরোধী গণ–অভ্যুত্থানের পরও আমরা গুণগত পরিবর্তন আনতে ব্যর্থ হয়েছি। অনেকে বলছেন, ২০২৪ সালের পালাবদলে অনেক ভিন্ন মাত্রা রয়েছে, এবং এই পরিবর্তনের ধারা থেকেই অন্যান্য রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানের পাশাপাশি শিক্ষা ক্ষেত্রেও সংস্কার আনার দাবি জোরদার হয়েছে।

কিন্তু বাস্তবে দেখা যাচ্ছে, সরকারপ্রধানের নির্দেশেই হোক বা আমলাতান্ত্রিক জটিলতার কারণে হোক, এখনো এ বিষয়ে কোনো বাস্তবধর্মী পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি। আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার ইতিহাস বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে, যতটুকু পরিবর্তন হয়েছে, তা মূলত শাসকের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক দর্শন প্রয়োগের প্রয়াস থেকে এসেছে। ফলে প্রতিবারই পরিবর্তন ক্ষণস্থায়ী ও ত্রুটিপূর্ণ হয়েছে। সরকার পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে শিক্ষাব্যবস্থাও নতুন রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক প্রভাবের অধীন আবর্তিত হয়েছে।

শিক্ষাব্যবস্থার এই সাধারণীকরণের প্রবণতা নীতিনির্ধারকদের শিক্ষা বিষয়ে দুর্বল ও ত্রুটিপূর্ণ ধারণায় পরিচালিত করেছে, ফলে সঠিক কর্মপন্থা বা পরিবর্তনের পদক্ষেপ চিহ্নিত করতে তারা পিছিয়ে থেকেছে। শিক্ষা ব্যবস্থাপনায় নারী, ধর্ম, বিবর্তনবাদ, রাষ্ট্রচিন্তায় ধর্মীয় দৃষ্টিভঙ্গি, মানবসভ্যতার বিবর্তন ইত্যাদি বিষয় কীভাবে পড়ানো হবে এবং কোন আদর্শের আলোকে ব্যাখ্যা করা হবে—এসব ক্ষেত্রেও শাসকগোষ্ঠীর নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি অনুসৃত হয়েছে।

ফলে সমাজে নানা মতাদর্শ, দর্শন ও বিশ্বাসের বিভাজন তৈরি হয়েছে, যা পাঠ্যসূচির বিষয়বস্তুর গ্রহণ-বর্জন নির্ধারণে দ্বিধা ও বিতর্ক সৃষ্টি করেছে। এর ফলে আমরা আজ অবধি কোনো সর্বজনীন ও দীর্ঘমেয়াদি শিক্ষা কাঠামো দাঁড় করাতে পারিনি। শিক্ষার এই দুর্বল জনভিত্তি নানা স্তরে বিভাজন তৈরি করেছে, যা যুগোপযোগী ও সহায়ক শিক্ষাব্যবস্থার পথে বড় বাধা হয়ে আছে। অথচ শিক্ষা জাতি গঠনের প্রধান ও প্রাথমিক পদক্ষেপ, যা হতে হবে সময়োপযোগী, সুচিন্তিত ও সুনির্দিষ্ট লক্ষ্যে পরিচালিত। গত ৫৪ বছরে আমরা এ কাজে বারবার ব্যর্থ হয়েছি।

এই প্রেক্ষাপটে বিশেষত ২০২৪ সালের রাজনৈতিক পরিবর্তনের আলোকে শিক্ষার মতো একটি বৃহৎ বিষয়কে বাস্তবভিত্তিক, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিনির্ভর, বৈশ্বিক চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় সক্ষম এবং নিজস্ব সংস্কৃতি ও বিশ্বাসের ভিত্তিতে প্রণীত একটি রূপকল্প তৈরি করা এখন সময়ের দাবি। প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের নানা রাষ্ট্র শিক্ষার উন্নয়নের মাধ্যমে নিজেদের কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে পৌঁছেছে। তাদের উন্নয়ন নীতিমালা ও কর্মপন্থা থেকে শিক্ষা নেওয়ার সুযোগ আমাদের রয়েছে।

কিন্তু আমরা এখনো জ্ঞান ও দক্ষতাভিত্তিক সহায়ক শিক্ষাব্যবস্থা গড়ে তুলতে ব্যর্থ। ফলে উদ্যোক্তা সৃষ্টির জ্ঞান আমাদের শিক্ষাব্যবস্থায় সীমিত, অনেক ক্ষেত্রে অনুপস্থিতও। এ তো কেবল বুদ্ধিবৃত্তিক সীমাবদ্ধতার একটি চিত্র—এর পাশাপাশি রয়েছে বহুমাত্রিক, জটিল প্রতিবন্ধকতা, যা নিবন্ধের শুরুতেই ইঙ্গিত করা হয়েছে।

শিক্ষা, শিক্ষক, শিক্ষার্থী ও প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো—এগুলোই শিক্ষাব্যবস্থার মূল নিয়ামক। কিন্তু বাস্তবে চিত্রটি জরাজীর্ণ, বিবর্ণ ও দুঃখময়। প্রাথমিক থেকে উচ্চশিক্ষা পর্যন্ত এ অবস্থা বিদ্যমান। গবেষণা, প্রযুক্তি ব্যবহার, প্রশিক্ষণ, সময়মতো পদোন্নতি, নতুন পদ সৃজন, অবকাঠামো সংস্কার ও বাজেট বৃদ্ধি—এসবের বদলে দেখা যায় বদলি বাণিজ্য, পদোন্নতির বিলম্ব, প্রশিক্ষণ ও অর্থায়নের ঘাটতি, ত্রুটিপূর্ণ পরীক্ষা ও মূল্যায়ন, প্রযুক্তিভিত্তিক জ্ঞানের অভাব, উচ্চশিক্ষায় নেতৃত্ব দিতে সক্ষম শিক্ষা ক্যাডারের অবমূল্যায়ন, অন্যান্য ক্যাডারের আধিপত্যসহ নানা সমস্যা।

শিক্ষার্থীদের অবস্থা আরও করুণ। তারা সনদনির্ভর শিক্ষায় আবদ্ধ, যা কর্মসংস্থান, পেশাগত উন্নয়ন বা উদ্যোক্তা সৃষ্টিতে সামান্যই অবদান রাখছে। বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতেও গবেষণার পর্যাপ্ত বরাদ্দ নেই, নেই উদ্ভাবন ও বাস্তবভিত্তিক পাঠ্যক্রম। সার্বিকভাবে দেখা যায়, আমাদের শিক্ষাব্যবস্থায় ব্যক্তি বিকাশ ও মানবসম্পদে পরিণত হওয়ার বদলে কেবল বেঁচে থাকার জন্য প্রহসনমূলক স্বীকৃতি অর্জনই যেন লক্ষ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে।

শিক্ষা নিয়ে ভাবনা বা নীতিমালা তৈরি হয়েছে বটে, তবে তা দীর্ঘমেয়াদে কার্যকর হয়নি। স্বাধীনতার পর থেকে শিক্ষা কমিশন ও নীতিমালাগুলো প্রাসঙ্গিকতা থাকা সত্ত্বেও সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য অর্জনে ব্যর্থ হয়েছে। তাই এখন বাস্তবভিত্তিক আলোচনা ও পর্যালোচনার মাধ্যমে সঠিক সিদ্ধান্ত নিয়ে শিক্ষা সংস্কারে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করে জাতিকে এগিয়ে নেওয়ার একটি চূড়ান্ত রূপরেখা প্রণয়ন জরুরি।


 

Side banner