বসুন্ধরা গ্রুপের চেয়ারম্যান আহমেদ আকবর সোবহান ও তাঁর পরিবারের সাত সদস্যের নামে ২২ কোম্পানিতে থাকা ৭৫ কোটি ৪৬ লাখ ৯০ হাজার ৩০২টি শেয়ার অবরুদ্ধ করার আদেশ দিয়েছেন আদালত।
দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে গত মঙ্গলবার (২৯ এপ্রিল) ঢাকা মহানগরের জ্যেষ্ঠ বিশেষ জজ মো. জাকির হোসেন এ আদেশ দেন।দুদকের উপপরিচালক (জনসংযোগ) আকতারুল ইসলাম এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন।তিনি বলেন, বসুন্ধরা গ্রুপের চেয়ারম্যান ও তাঁর পরিবারের সদস্যদের নামে থাকা মালিকানা শেয়ার এবং বিভিন্ন ব্যাংক হিসাবে জমা থাকা টাকা অবরুদ্ধ করার আদেশ দিয়েছেন আদালত। এসব শেয়ারের বাজারমূল্য ১ হাজার ৪৫৮ কোটি ৭৫ লাখ ৭ হাজার ৫২০ টাকা।
দুদকের তথ্যমতে, ওই পরিবারের সদস্যদের ৭০টি ব্যাংক হিসাবে থাকা ১৯ কোটি ৮১ লাখ ৭৪ হাজার ২৬৬ টাকা ও ১০ হাজার ৫৩৮ মার্কিন ডলার (বর্তমান বাজারমূল্যে ১২ লাখ ৮৫ হাজার টাকা) অবরুদ্ধ করারও আদেশ দিয়েছেন আদালত।
দুদক জানায়, যেসব কোম্পানিতে বসুন্ধরা গ্রুপের চেয়ারম্যান ও তাঁর পরিবারের সদস্যদের নামে থাকা শেয়ার জব্দ করার আদেশ হয়েছে, সেগুলো হলো ইস্ট ওয়েস্ট প্রপার্টি ডেভেলপমেন্ট প্রাইভেট লিমিটেড, মেঘনা সিমেন্ট মিলস লিমিটেড, বসুন্ধরা পেপার মিলস লিমিটেড, বসুন্ধরা এলপি গ্যাস লিমিটেড, বসুন্ধরা ইন্ডাস্ট্রিয়াল কমপ্লেক্স লিমিটেড, বসুন্ধরা স্টিল অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং লিমিটেড, বসুন্ধরা হর্টিকালচার লিমিটেড, বসুন্ধরা ফুড অ্যান্ড বেভারেজ ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড, বসুন্ধরা ড্রেজিং কোম্পানি লিমিটেড, বসুন্ধরা ইমপোর্ট এক্সপোর্ট লিমিটেড, বসুন্ধরা ট্রেডিং কোম্পানি লিমিটেড, ক্রিস্টাল প্রপার্টিজ লিমিটেড, বসুন্ধরা মাল্টিপেপার ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড, বসুন্ধরা প্যাকেজিং ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড, বসুন্ধরা গ্লাস ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড, ইউনাইটেড সিটি টুইন টাওয়ার ডেভেলপমেন্ট লিমিটেড, টগি রিয়েল স্টেট অ্যান্ড কনস্ট্রাকশন লিমিটেড, বসুন্ধরা সিমেন্ট ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড, বসুন্ধরা সিমেন্ট মিলস লিমিটেড, বসুন্ধরা সিটি ডেভেলপমেন্ট লিমিটেড, বসুন্ধরা টিস্যু ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড, ইস্ট ওয়েস্ট মিডিয়া গ্রুপ প্রাইভেট লিমিটেড।
দুদক বলেছে, ২২টি কোম্পানি ছাড়াও আরজেএসসিতে (যৌথ মূলধন কোম্পানি ও ফার্মসমূহের পরিদপ্তর) নিবন্ধিত আরও অনেক প্রতিষ্ঠানে বসুন্ধরার স্বার্থ রয়েছে। সেখানে তারা শেয়ার হস্তান্তরের চেষ্টা করছে। এসব শেয়ার হস্তান্তর হলে দুদকের অনুসন্ধান শেষে মামলা করা, অভিযোগপত্র দাখিল ও বিচার শেষে অপরাধলব্ধ আয় থেকে অর্জিত সম্পদ বাজেয়াপ্ত করা যাবে না। তাই এসব সম্পদ অবরুদ্ধ করা প্রয়োজন।
বসুন্ধরা গ্রুপের চেয়ারম্যান ও তাঁর পরিবারের সদস্যদের নামে দেশের বিভিন্ন ব্যাংকে ৭০টি ব্যাংক হিসাব পেয়েছে দুদক। আদালতে পাঠানো আবেদনে দুদক বলেছে, ১৯৯৯ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত এসব ব্যাংক হিসাবে ২ হাজার ৭৫ কোটি ২৪ লাখ ৫৯ হাজার ৫৭ টাকা ও ১ লাখ ৯২ হাজার ৩৪ মার্কিন ডলার লেনদেন হয়েছে। বর্তমানে এসব ব্যাংক হিসাবে ১৯ কোটি ৮১ লাখ ৭৪ হাজার ২৬৬ টাকা ও ১০ হাজার ৫৩৮ মার্কিন ডলার জমা রয়েছে।
এর আগে ১৮ ফেব্রুয়ারি বসুন্ধরা গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সায়েম সোবহান আনভীর ও তাঁর পরিবারের সদস্যদের নামে সংযুক্ত আরব আমিরাত, স্লোভাকিয়া এবং যুক্তরাজ্যে আরও স্থাবর-অস্থাবর সম্পদ অবরুদ্ধ করার আদেশ দেন আদালত। এসব সম্পদের মধ্যে রয়েছে কোম্পানির শেয়ার, ফ্ল্যাট ও ব্যবসায়িক স্থাপনা। আনভীরের নামে আরব আমিরাতের বুর্জ খলিফার ১১ তলায় একটি দুই বেডরুমের ফ্ল্যাট আছে, যার বাজারমূল্য ১২ কোটি ৪০ লাখ টাকা।
এরও আগে গত বছরের ৩ ডিসেম্বর বসুন্ধরা গ্রুপের চেয়ারম্যান আহমেদ আকবর সোবহানসহ তাঁর পরিবারের আট সদস্যের বিদেশে থাকা স্থাবর-অস্থাবর সম্পদ জব্দ ও অবরুদ্ধ করার আদেশ দিয়েছিলেন আদালত। দুদক আদালতকে এই আটজনের প্রায় ১৪৩ কোটি টাকার বিনিয়োগ, সম্পদ কেনা ও ব্যাংকে লেনদেনের তথ্য জানায়।
সম্পদ অবরুদ্ধ করার আবেদনে দুদক আদালতকে বলেছে, বসুন্ধরা গ্রুপের চেয়ারম্যান ও তাঁর পরিবারের সদস্যদের বিরুদ্ধে মানি লন্ডারিং, সরকারি রাজস্ব ফাঁকি, ভূমি জবরদখল, ঋণ জালিয়াতি, অর্থ আত্মসাৎ, অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগ অনুসন্ধানকালে আহমেদ আকবর সোবহান, তাঁর ছেলে সায়েম সোবহান আনভীর, সাদাত সোবহান, সাফিয়াত সোবহান, সাফওয়ান সোবহান, সায়েম সোবহানের স্ত্রী সাবরিনা সোবহান, সাদাত সোবহানের স্ত্রী সোনিয়া ফেরদৌসী সোবহান এবং সাফওয়ান সোবহানের স্ত্রী ইয়াশা সোবহানের নামে ও স্বার্থসংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের নামে স্লোভাকিয়া ও সাইপ্রাসে বিপুল অর্থ বিনিয়োগের তথ্য পাওয়া গেছে। বাংলাদেশের নাগরিক হয়ে বিদেশি পাসপোর্ট ও নাগরিকত্ব গ্রহণ করে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে কোনো অনুমতি না নিয়ে বিপুল অর্থ বিনিয়োগ করেছেন তাঁরা।
আদালতে জমা দেওয়া দুদকের আবেদনে আরও বলা হয়েছে, বসুন্ধরা গ্রুপের চেয়ারম্যান ও তাঁর পরিবারের সদস্যরা স্লোভাকিয়া, সেন্ট কিটস অ্যান্ড নেভিস, সুইজারল্যান্ড, ব্রিটিশ ভার্জিন আইল্যান্ড, যুক্তরাজ্য ও সিঙ্গাপুরে একাধিক কোম্পানি, ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে বিপুল অর্থ বিনিয়োগ করেছেন। এ ছাড়া সংযুক্ত আরব আমিরাতের হাবিব ব্যাংক লিমিটেডে এবং সাইপ্রাসের ইউরো ব্যাংকে তাঁদের বিপুল অর্থ লেনদেনের তথ্য পাওয়া গেছে। সাইপ্রাসে বাড়ি কেনার তথ্য পাওয়া গেছে। তাঁরা বাংলাদেশ সরকারের অনুমতি না নিয়ে বিদেশে এসব সম্পদ কিনেছেন। সায়েম সোবহান আনভীর ৩০ লাখ ইউরো (বর্তমান মূল্যে প্রায় ৩৮ কোটি টাকা) বিনিয়োগ করে স্লোভাকিয়ার নাগরিকত্ব নেন। তাঁর স্ত্রী ইয়াশা সোবহান ২০ লাখ ইউরো (২৫ কোটি টাকা) বিনিয়োগ করে নাগরিকত্ব নেন সাইপ্রাসের। আহমেদ আকবর সোবহান ও তাঁর স্ত্রী আফরোজা বেগম আড়াই লাখ মার্কিন ডলার (প্রায় তিন কোটি টাকা) বিনিয়োগ করে নাগরিকত্ব নেন ক্যারিবীয় অঞ্চলের দ্বীপরাষ্ট্র সেন্ট কিটস অ্যান্ড নেভিসে।
আহমেদ আকবর সোবহানের পরিবারের আট সদস্য বিভিন্ন দেশের ১৯টি কোম্পানিতে বিনিয়োগ করেছেন বলে আদালতকে জানিয়েছে দুদক। সংস্থাটি আরও বলেছে, সাফওয়ান সোবহান ও তাঁর স্ত্রী সোনিয়া ফেরদৌসী সোবহান সংযুক্ত আরব আমিরাতের হাবিব ব্যাংক ও সাইপ্রাসের ইউরো ব্যাংকে হিসাব খুলে অবৈধ অর্থ লেনদেন করেন।
এর আগে গত বছরের ২১ অক্টোবর আহমেদ আকবর সোবহানসহ তাঁর পরিবারের আট সদস্যের দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা দেন আদালত। ###
আপনার মতামত লিখুন :