ঢাকা শুক্রবার, ০১ আগস্ট, ২০২৫, ১৭ শ্রাবণ ১৪৩২
সেনা সদরের ব্রিফিং

গোপালগঞ্জে এনসিপির অনেকের জীবননাশের হুমকি ছিল

দৈনিক নতুন সংবাদ জুলাই ৩১, ২০২৫, ১১:২০ পিএম গোপালগঞ্জে এনসিপির অনেকের জীবননাশের হুমকি ছিল

গোপালগঞ্জে জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) অনেকের জীবননাশের হুমকি ছিল বলে জানিয়েছে সেনা সদর। তারা বলেছে, সেই ব্যক্তিদের জীবন বাঁচানোর জন্যই সেনাবাহিনী সহায়তা করেছে। আত্মরক্ষার্থে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী বলপ্রয়োগে বাধ্য হয়েছে। এখানে জীবন বাঁচানোই মূল লক্ষ্য ছিল, অন্য কিছু নয়।

বৃহস্পতিবার (৩১ জুলাই) দুপুরে সেনা সদরের এক প্রেস ব্রিফিংয়ে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে এসব কথা বলা হয়েছে। ঢাকা সেনানিবাসের অফিসার্স মেস-এ-তে অনুষ্ঠিত এই ব্রিফিংয়ে দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতিসহ সমসাময়িক বিভিন্ন বিষয়ে কথা বলেন সেনাবাহিনীর মিলিটারি অপারেশনসের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. নাজিম-উদ-দৌলা এবং সেনা সদরের মিলিটারি অপারেশনস ডাইরেক্টরেটের কর্নেল স্টাফ কর্নেল মো. শফিকুল ইসলাম।

সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. নাজিম-উদ-দৌলা বলেন, ‘প্রত্যেকটি জীবন মূল্যবান। যেকোনো কারণেই হোক, কোনো জীবনহানি ঘটবে এটা আমরা আশা করি না। গোপালগঞ্জে যে ঘটনাটি ঘটেছে, এটা অবশ্যই দুঃখজনক। কিন্তু কোন প্রেক্ষাপটে ঘটেছে, কেন সেখানে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে বলপ্রয়োগ করতে হয়েছে, সে ব্যাপারেও সরকারের পক্ষ থেকে তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে।’

গোপালগঞ্জে সেনাবাহিনীর তৎপরতাসংক্রান্ত এক প্রশ্নের জবাবে নাজিম-উদ-দৌলা বলেন, ‘কোনো দলকে নয়, কোনো ব্যক্তিকে নয়, বরং যাদের জীবন হুমকির মুখে পড়েছে, সেটি বিবেচনা করেই তাদেরকে উদ্ধার করেছি। ইতিপূর্বেও একই কাজ করেছি। কোনো দল নয়, জীবন রক্ষার্থেই এই কাজটি করতে হয়েছিল।’

নাজিম-উদ-দৌলা আরও বলেন, সেনাবাহিনীর আয়ত্তের ভেতরে আছে, কাছাকাছি বা দায়িত্বের ভেতরে আছে এমন সময় কারও জীবন বিপন্ন হবে, এ সময় সেনাবাহিনী চুপ থাকতে পারে না। এ ক্ষেত্রে যে কারও বিষয়ে আমাদের অবস্থান একই। ‘সিনিয়র লিডারশিপের’ (ঊর্ধ্বতন নেতৃত্বের) নির্দেশনা একইভাবে দেওয়া। কোনো একটা জীবন মৃত্যুর মুখোমুখি হয়েছে, এ সময় তাকে মৃত্যুর মুখে রেখে বা তার প্রতি নজর না দিয়ে সেনাবাহিনী দাঁড়িয়ে থাকতে পারে না। অবশ্যই সেনাবাহিনীর জন্য জীবন রক্ষা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। সেই কাজটিই করেছি এবং করব।

সেনাবাহিনীর মিলিটারি অপারেশনসের পরিচালক বলেন, ‘একটা বিপৎসংকুল সময় আমরা পার করছি। এ অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য সবার সহযোগিতা দরকার। আমরা যেন সম্মিলিতভাবে কাজ করে এ অবস্থা থেকে উত্তরণ ঘটাতে পারি।’

গোপালগঞ্জের ঘটনার বিষয়ে আগাম কোনো তথ্য ছিল কি না, থাকলে ব্যবস্থা নেওয়া গেল না কেন—এসব বিষয়ে সংবাদ সম্মেলনে সেনাবাহিনীর বক্তব্য জানতে চাওয়া হয়। জবাবে সেনা কর্মকর্তা শফিকুল ইসলাম বলেন, ‘যেকোনো রাজনৈতিক দল কোথায় তাদের সভা, সমাবেশ বা বৈঠক করবে এটা মূলত স্থানীয় প্রশাসন ও পুলিশের কাছ থেকে ক্লিয়ারেন্স নিতে হয়। এ বিষয়ে তারা জানত, আমাদের কাছে আগাম কোনো তথ্য ছিল না।’

গোপালগঞ্জে প্রাণঘাতী অস্ত্রের ব্যবহার নিয়ে অভিযোগের বিষয়ে এক প্রশ্নের জবাবে কর্নেল স্টাফ কর্নেল শফিকুল ইসলাম বলেন, ‘এটা একটা অনাকাঙ্ক্ষিত পরিস্থিতি ছিল। যেখানে শুধু ইটপাটকেল নিক্ষেপ করা হয়নি, ককটেল নিক্ষেপ করা হয়েছে। সেখানে জীবননাশের হুমকি ছিল। তখন আত্মরক্ষার্থে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী বলপ্রয়োগ করতে বাধ্য হয়েছে। এখানে প্রাণঘাতী কোনো অস্ত্রের ব্যবহার করা হয়নি।’

এনসিপির প্রসঙ্গ উল্লেখ করে এক সাংবাদিক জানতে চান একটি রাজনৈতিক দলের ক্ষেত্রে সেনাবাহিনীর বিশেষ কোনো দুর্বলতা আছে কি না—জবাবে এই সেনা কর্মকর্তা বলেন, ‘বিশেষ কোনো দলের ক্ষেত্রে সেনাবাহিনীর আলাদা কোনো নজর নেই। দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে সবাই সমান। তবে যেখানে জনদুর্ভোগ ও জীবননাশের হুমকি থাকে সেখানে সেনাবাহিনী কঠোর হয়। জনসাধারণকে সহায়তা করে থাকে। সেখানে (গোপালগঞ্জ) সেনাবাহিনী যদি সঠিকভাবে দায়িত্ব পালন না করত, তাহলে আরও হতাহত বা জীবননাশের শঙ্কা থাকত। সেই হিসেবে সেনাবাহিনী সেটা করেছে।’

মেজর সাদিক হেফাজতে

মেজর সাদিক নামের একজন আওয়ামী লীগের লোকজনকে প্রশিক্ষণ দিয়েছে, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এমন একটি খবর ছড়িয়েছে। এ বিষয়ে কর্নেল স্টাফ কর্নেল মো. শফিকুল ইসলাম বলেন, ‘মেজর সাদিকের বিষয়ে আমরা অবগত। তাঁর বিষয়ে তদন্ত চলমান। তদন্ত শেষে এ বিষয়ে বলতে পারব।’

এ প্রসঙ্গে ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. নাজিম-উদ-দৌলা বলেন, ‘এ রকম ঘটনা জানার পরে সেনাবাহিনীর হেফাজতেই তিনি আছেন। তদন্তে দোষ প্রমাণিত হলে নিঃসন্দেহে প্রচলিত নিয়ম অনুযায়ী সেনাবাহিনী তাঁর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেবে।’

বাংলাদেশ ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যকার ‘টাইগার লাইটনিং’ কর্মসূচি নিয়ে জানতে চাওয়া হলে তিনি বলেন, ‘এটি একটি প্রশিক্ষণ। এটা বাংলাদেশ সেনাবাহিনী যুক্তরাষ্ট্রের সেনাবাহিনীর সঙ্গে করে থাকে। এটা মূলত জ্ঞান ও প্রশিক্ষণ বিনিময়ের একটি কর্মসূচি। নিয়ম অনুসারে এটি প্রতিবছরই হয়ে থাকে। এটা নতুন কোনো কিছু না।’

আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি

চাঁদাবাজি–সংক্রান্ত এক প্রশ্নের উত্তরে কর্নেল স্টাফ কর্নেল মো. শফিকুল ইসলাম বলেন, চাঁদাবাজি বা এ ধরনের ঘটনাগুলো নিয়ন্ত্রণের জন্য যে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীগুলোর দায়িত্ব পালন করার কথা, তারা আরও সক্রিয় হলে এ ধরনের ঘটনা কমে আসবে। এর সঙ্গে সেনাবাহিনীও তার আভিযানিক দায়িত্ব পালন করছে। সবাই একত্রে কাজ করলে চাঁদাবাজি আরও কমে আসবে।

আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি–সংক্রান্ত আরেক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, সকল আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে একত্রে কাজ করতে হবে। যাদের অগ্রভাগে কাজ করার কথা তাদের আরও কার্যকর হতে হবে। আর সেনাবাহিনীর কথা বিশেষভাবে বললে, তাদের যে ম্যাজিস্ট্রেসি ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে, সে অনুযায়ী তারা শুধু তল্লাশি ও অপরাধীদের গ্রেপ্তার করতে পারে। গ্রেপ্তারের পর সেনাবাহিনীর করার কিছু থাকে না। এ জন্য সবাইকে একযোগে কাজ করতে হবে।

পার্বত্য চট্টগ্রাম পরিস্থিতি

সেনাবাহিনীর মিলিটারি অপারেশনসের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. নাজিম-উদ-দৌলা বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রামে যে দলগুলো আছে, তারা আধিপত্য বিস্তার ও চাঁদাবাজির ঘটনাকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন সময়ে মারামারি, হানাহানি ও গোলাগুলি হয়। সেনাবাহিনী এ বিষয়ে কাজ করছে, যাতে এটা নিয়ন্ত্রণের মধ্যে থাকে। আর সেনাবাহিনী একাই পার্বত্য চট্টগ্রামের দায়িত্বে নয়। বেসামরিক প্রশাসন, পুলিশ প্রশাসন সবাই এটার অংশ। সবাই সম্মিলিতভাবে কাজ করলে সেখানকার পরিস্থিতি সহনীয় জায়গায় রাখা সম্ভব।

আরাকান আর্মির কাছ থেকে কেএনএফ অস্ত্র পাচ্ছে এমন বিষয় উল্লেখ করে এক সাংবাদিক এ বিষয়ে সেনাবাহিনীর বক্তব্য জানতে চান। এ প্রসঙ্গে নাজিম-উদ-দৌলা বলেন, ‘আরাকান আর্মি এখন এমন একটি অবস্থায় আছে, তাদের সঙ্গে কেএনএফের যোগসূত্র সৃষ্টি হওয়া অস্বাভাবিক কিছু নয়। তারা মোটামুটি একই গোত্রের মানুষ এবং একই ধরনের মানসিকতা নিয়ে কাজ করছে। সে ক্ষেত্রে কেএনএফ আরাকান আর্মির কাছ থেকে যদি কোনো অস্ত্র পেয়েও যায়, তাহলে আমি অবাক হব না। তবে পূর্বের অবস্থা থেকে বহুলাংশে কেএনএফের আধিপত্য ও কর্মক্ষমতা কমেছে। তারা নাজুক অবস্থায় আছে।’

পাহাড়ে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড–সংক্রান্ত এক প্রশ্নের জবাবে কর্নেল শফিকুল ইসলাম বলেন, যেকোনো দুষ্কৃতকারী দল এটা করবেই। বিভিন্নভাবে মানুষের কাছ থেকে চাঁদা আদায় করা এগুলো করে থাকে। সেনাবাহিনীর কার্যক্রম ও অভিযান জারি রয়েছে। বর্তমান যে ক্যাম্প আছে সেখান থেকে বা টিওবি (টেম্পোরারি অপারেটিং বেজ) থেকে এই অভিযানগুলো পরিচালনা করা হয়। যাতে চাঁদাবাজিসহ এ ধরনের ঘটনা কমে আসে।

শফিকুল ইসলাম আরও বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রামে যে ক্যাম্পগুলো গুটিয়ে নিয়ে আসা হয়েছে, সেখানে বর্তমানে যে ক্যাম্পগুলো আছে, সেখান থেকে আভিযানিক কার্যক্রম পরিচালনা করা হচ্ছে। এতে কার্যক্রমে কোনো সমস্যা হচ্ছে না। সেনাবাহিনী খুব ভালোভাবেই সেখানে কাজ করছে।

সবশেষে সেনা সদরের মিলিটারি অপারেশনস ডাইরেক্টরেটের কর্নেল স্টাফ কর্নেল মো. শফিকুল ইসলাম উত্তরার মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজে যুদ্ধবিমান বিধ্বস্তের প্রসঙ্গে কথা বলেন। তিনি বলেন, ওই ঘটনায় পার্শ্ববর্তী ক্যাম্পে থাকা সেনাসদস্যরা সবার আগে সাড়া দিয়েছে। সর্বোচ্চ আন্তরিকতা ও পেশাদারত্বের সঙ্গে তারা কাজ করেছে। ###

Side banner