জাতি গঠনে ব্যক্তিচিন্তা বাদ দিয়ে জাতীয় অগ্রাধিকার চিহ্নিত করার পরামর্শ দিয়ে পরিবেশ, বল ও জলবায়ু পরিবর্তন এবং পানি সম্পদ উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বলেছেন, আমাদের জাতি গঠনের ভিত্তিটা হচ্ছে সন্দেহ, কেউ এখানে কাউকে বিশ্বাস করে না। আমরা হয়ত কোনটা আমাদের একসঙ্গে জাতির প্রাধান্য এইটাও ঠিক করতে পারি না। আমরা খুব তাড়াতাড়ি একজন আরেকজনের প্রতিপক্ষ হয়ে যাই। কিন্তু সন্দেহ আর অবিশ্বাস নিয়ে একটা গঠিত হতে পারে না। আমাদের দুর্ভাগ্য যে আমাদের পালাবদল সব সময়ই রক্তাক্ত হয়, সব সময় হিংস্র হয়। জাতি হিসেবে এগিয়ে যেতে হলে আমাদের আসলে যার যেটা দলমত থাকুক না কেন জাতীয় অগ্রাধিকারগুলো ঠিকমত চিহ্নিত করতে হবে।
মঙ্গলবার (২৮ অক্টোবর) রাজধানীর চীন-মৈত্রী আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্র অনুষ্ঠিত ইউনিভার্সিটি অব লিবারেল আর্টস অব বাংলাদেশ-ইউল্যাব অষ্টম সমাবর্তন অনুষ্ঠানে তিনি এসব কথা বলেন।
রাষ্ট্রপতি ও আচার্য মো. সাহাবুদ্দিনের প্রতিনিধি হিসেবে সমাবর্তন অনুষ্ঠানে বক্তব্য রাখেন অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান।
অনুষ্ঠানে সমাবর্তন বক্তব্য রাখেন এপেক্স ফুটওয়ার লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ নাসিম মনজুর। সমাবর্তনে বিশেষ অতিথি হিসেবে বক্তব্য রাখেন বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের সদস্য অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ আইয়ুব ইসলাম। অনুষ্ঠানে স্বাগত বক্তব্য রাখেন ইউল্যাবের উপাচার্য অধ্যাপক ইমরান রহমান।
পরিবেশ উপদেষ্টা বলেন, ‘জাতি গঠন শুধুমাত্র ব্যক্তি চিন্তা দিয়ে হয় না। আমি দায়িত্বপালন করতে এসে দেখেছি, আমাদের জাতি গঠনের ভিত্তিটা হচ্ছে সন্দেহ। কেউ এখানে কাউকে বিশ্বাস করে না। আমরা হয়তো কোনটা আমাদের একসঙ্গে জাতির প্রাধান্য এইটাও ঠিক করতে পারি না। আমরা খুব তাড়াতাড়ি একজন আরেকজনের প্রতিপক্ষ হয়ে যাই। কিন্তু সন্দেহ আর অবিশ্বাস নিয়ে একটা গঠিত হতে পারে না। যতক্ষণ এই সন্দেহ আর অবিশ্বাস টাই দৃঢ় থাকবে, ততক্ষণ কিন্তু জাতি বিভাজিত থাকবে। আমাদের দুর্ভাগ্য যে আমাদের পালাবদল সব সময়ই রক্তাক্ত হয়, সব সময় হিংস্র হয়। যার জন্য বিভাজনকে রাতারাতি কমিয়ে আনা—সরকার চাইলেও, আন্তরিক প্রচেষ্টা করলেও সব সময় সহজ হয় না।
শিক্ষার্থীদের উদ্দেশে তিনি বলেন, আপনাদের এই ইউল্যাবে পড়ার কারণে আমার বিশ্বাস আপনারা শুধু চিন্তা করতেই শেখেননি, চিন্তাটা কেন করতে হবে এটাও শিখেছেন। কীভাবে করতে হবে এটাও শিখেছেন। কার জন্য করতে হবে এটাও শিখেছেন। আজকে আপনারা কেউ বিসিএস দেবেন ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, টিচার হবেন, কিন্তু জাতীয় অগ্রাধিকারগুলো আমাদের পেশাগত জায়গার ঊর্ধ্বে উঠে দলীয় বিশ্বাসের রাজনীতির ঊর্ধ্বে উঠে ঠিক করতে হবে। আমার কাছে মনে হয় একটি জাতি হিসেবে সফল হতে হলে কয়েকটা বিষয় আমাদের সব সময় মনে রাখতে হবে, ব্যক্তি হিসেবে সফল হতে গেলেও এক হচ্ছে আপনাকে অবিচল হতে হবে, আপনি কী জানতে চান বা কী করতে চান এই ফোকাসটা যদি ঠিক না থাকে, তাহলে কিন্তু আমরা আগাতে পারবো না।
উপদেষ্টা বলেন, আমাদের রাজনীতি এত বৈরী যে অন্য পক্ষকে ঘায়েল করতে সব সময় তথ্যকে এমনভাবে ব্যবহার করা হয়েছে যে জাতির ফোকাসটা নষ্ট হয়ে যায়, যে বিষয়ে আমাদের কথা বলা দরকার, সে বিষয়ে আমরা কথা না বলে চারপাশের বিষয়গুলোকে নিয়ে আমরা কথা বলতে থাকি। আমাদের জাতীয় জীবনে বিতর্কের ঊর্ধ্বে কোনও মানুষকে থাকতে দেওয়া হয় না। মনে রাখতে হবে হবে এইটা ডেলিবারেট, কেনও ডেলিবারেট, সবাইকে যদি আপনি বদনামি করে ফেলতে পারেন তাহলে দুর্নীতির যে রাজত্ব, সেই রাজত্ব করাটা সহজ হয়। কাজেই অপপ্রচার থেকে নিজেকে মুক্ত রেখে আমার ফোকসটা আমাকে ঠিক রাখতে হবে। আমি যেটা করবো এটাতে একটা অবিচল এফোর্ট আমার থাকবে। আমাদের মতন দেশে কোনও কিছু পরিবর্তন করা রাতারাতি হতেই পারে না। এত রকমের বাধা।
শিক্ষার্থীদের উদ্দেশে রিজওয়ানা হাসান বলেন, আপনাদের গ্র্যাজুয়েশনের মাধ্যমে আমি মনে করি বাংলাদেশের জাতিগত একটা অর্জন। একটা উচ্চশিক্ষিত সেক্টর এখান থেকে বাহির হলো, যারা জাতি গঠনে ভূমিকা রাখবে। যদি নিজে ঠিক না হই তাহলে সমাজকে কেমন করে ঠিক করবো। তো আমার ফোকাস ঠিক করা, আমার সততা ঠিক করার পাশিাপাশি আমার নিজের জন্য কী করতে পারি আর জাতির জন্য কী করতে পারি এটাও একসঙ্গে ভেবে নেওয়াটা জরুরি। হতাশ করে দেওয়ার একটা প্রচেষ্টা চলছে, কিছুই হচ্ছে না, কিছুই বদলাচ্ছে না, সবাই হতাশ হয়ে যেতে হবে, হতাশা কিন্তু আমাদের ধর্মেও নিষিদ্ধ। আমি যে ধর্ম বিশ্বাস করি, যে ধর্মের চর্চা করি, যে ধর্মেও হতাশা নিষিদ্ধ। হতাশ হওয়ার কোনও সুযোগ নেই, হতাশ হচ্ছেন কেনও জানেন? কারণ আপনার কাজটা আপনারই করছেন না, আপনার কাজটা যদি আপনি করতেন, দেখতেন আপনি হতাশ হতেন না। আপনার মধ্যে সব সময় একটা আশা থাকতো যে আমি তো কাজ করেই যাচ্ছি তাহলে দেশটা কেনও বদলাবে না। আপনাদের ওপর দায়িত্ব কিন্তু দেশ গড়বার না শুধু দায়িত্ব হচ্ছে দেশটাকে বদলানোর। যে দেশটা আছে সেই দেশে নিজের ক্যারিয়ার গড়ার চিন্তা করলে হবে না। সে জন্য জুলাই-আগস্ট হয়নি। আমরা নিজেদের ক্যারিয়ার যেমন গড়বো, দেশ যেমন গড়বো, একটা পরিবর্তিত বাংলাদেশ গড়বো। যে বাংলাদেশ আছে সেই স্ট্যাটাস মেইনটেনইন করলে হবে না, আমাদের পরিবর্তিত বাংলাদেশ গড়তে হবে। আর এই পরিবর্তন একদিনে চলে আসে না, একমাসে চলে আসে না, এটা একটা প্রক্রিয়ার ব্যাপার। সেখানে আমার অবস্থান কী হবে সেটা আমাকে বুঝতে হবে।
আপনার মতামত লিখুন :