রাজধানী ঢাকার হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর (ঢাকা বিমানবন্দর) ও চট্টগ্রামে হুট করে তিনটি বড় অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা দেশে নানা ধরনের আলোচনার জন্ম দিয়েছে। অনেকেই এসব ঘটনাকে ‘নিছক দুর্ঘটনা’ বলে মানতে রাজি নন। ঢাকায় বিমানবন্দরে ভয়াবহ আগুনের ঘটনার পর সরকারের বিবৃতিতেই ‘নাশকতা’, ‘জনমনে আতঙ্ক’ কিংবা ‘বিভাজন সৃষ্টির’ মতো শব্দগুলোর ব্যবহার অনেকের দৃষ্টি কেড়েছে। বিমানবন্দরে আগুন নিয়ে সরকারের শীর্ষ পর্যায়ে পাঠানো একটি গোয়েন্দা প্রতিবেদন ঘিরে সন্দেহ আরও দানা বাঁধতে শুরু করেছে।
শনিবার (১৮ অক্টোবর) প্রধান উপদেষ্টার ভেরিফায়েড ফেসবুক পেজে এক বিবৃতি বলা হয়েছে, ঢাকার বিমানবন্দরের কার্গো ভিলেজসহ অন্যান্য অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় নাশকতা বা অগ্নিসংযোগের কোনো বিশ্বাসযোগ্য প্রমাণ পাওয়া গেলে সরকার তাৎক্ষণিক ও দৃঢ় পদক্ষেপ নেওয়া হবে বলে জানিয়েছে অন্তর্বর্তী সরকার।
আরও বলা হয়, অন্তর্বর্তী সরকার দেশের একাধিক স্থানে সংঘটিত কয়েকটি বড় অগ্নিকাণ্ড নিয়ে জনগণের উদ্বেগ সম্পর্কে সচেতন। আমরা সব নাগরিককে আশ্বস্ত করতে চাই যে, নিরাপত্তা বাহিনী প্রতিটি ঘটনার বিস্তারিত তদন্ত করছে এবং সর্বোচ্চ সতর্কতার সঙ্গে মানুষের জীবন ও সম্পত্তি রক্ষায় কাজ করছে।
ঢাকা বিমানবন্দরের মতো গুরুত্বপূর্ণ স্থানে প্রায় ২৭ ঘণ্টা ধরে আগুন জ্বলেছে। আগুন নেভাতে কাজ করতে হয়েছে ৩৭টি ইউনিটকে। ভয়াবহ এ আগুনের কারণে আন্তর্জাতিক ফ্লাইট বাতিল বা অন্য বিমানবন্দরে অবতরণও করাতে হয়েছে।
একের পর এক অগ্নিকাণ্ড নিয়ে যখন জনমনে প্রশ্ন উঠছে সেই মুহূর্তে বিমানবন্দরে আগুন নিয়ে সরকারের শীর্ষ পর্যায়ে পাঠানো একটি গোয়েন্দা প্রতিবেদন ঘিরে সন্দেহ আরও দানা বাঁধতে শুরু করেছে। সেখানে এমন কিছু তথ্য তুলে ধরা হয়েছে-যা ইঙ্গিত করে একটি পক্ষ শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের অগ্নিকাণ্ডে বিপুল ক্ষয়ক্ষতির প্রেক্ষাপট তৈরি করেছে। এমনকি আগুন নেভাতে পুলিশের একটি ইউনিটকে অনুমতি পর্যন্ত দেওয়া হয়নি। অথচ সেখানে উপস্থিত কর্তব্যরত সদস্যরা প্রায় নিষ্ক্রিয় অবস্থায় ছিল বলেও প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে।
সরকারের কাছে পাঠানো প্রতিবেদনটিতে স্পষ্ট করে বলা হয়েছে, বিমানবন্দরের আমদানি কার্গো ভিলেজে ভয়াবহ আগুনের নেপথ্যে গোয়েন্দা তৎপরতা ও সমন্বয়ের অভাব ছিল। অগ্নিকাণ্ডের শুরুতেই উপযুক্ত মনিটরিং, পেট্রোলিং ও নিরাপত্তার দায়িত্বে নিয়োজিত সদস্যরা সক্রিয় থাকলে দ্রুত এই আগুন নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব হতো।
শাহজালাল বিমানবন্দরের আমদানি কার্গো এলাকায় গত বছরের ৫ আগস্ট এর আগে এপিবিএনের তিন স্তরবিশিষ্ট একটি নিরাপত্তা বলয় ২৪ ঘণ্টা দায়িত্ব পালন করত। স্তর তিনটি হলো, ওয়াচ টাওয়ার নিরাপত্তা ডিউটি, ফুট পেট্রোল ও গোয়েন্দা কার্যক্রম। ওয়াচ টাওয়ার নিরাপত্তা ডিউটির আওতায়, এয়ারসাইড থেকে গোডাউনে প্রবেশের মুখে তিনটি ১২ ফুট উঁচু চেয়ারবিশিষ্ট পোস্টে একজন এবং নিচে (ফিল্ডে) একজন করে মোট ছয়জন এপিবিএন সদস্য নিয়োজিত ছিল। তারা তিনটি ওয়াচ টাওয়ার থেকে পুরো আমদানি কার্গো এলাকা নজরদারি করত। ফুট পেট্রোল এর মধ্যে ছিল ৮নং হ্যাঙ্গার গেট থেকে ১১নং বোর্ডিং ব্রিজ পর্যন্ত পুরো এলাকায় দুটি ফুট পেট্রোল (প্রতি পেট্রোলে দুজন করে মোট চারজন) মোতায়েন ছিল। তারা আমদানি পণ্যের সুরক্ষা নিশ্চিত করতে নিয়োজিত ছিল। এছাড়া গোয়েন্দা কার্যক্রমের মধ্যে ছিল- পাঁচ সদস্যের একটি গোয়েন্দা দল, যারা সার্বক্ষণিক আমদানি ও রপ্তানি কার্গো এলাকায় বিভিন্ন সন্দেহভাজন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের সদস্যদের গতিবিধি নজরদারি করত এবং তা কর্তৃপক্ষকে অবহিত করত।
এয়ারসাইড কমান্ড অ্যান্ড কনট্রোল সেন্টারে দায়িত্বরত এপিবিএন ইনচার্জ উপরোক্ত তিন স্তরবিশিষ্ট নিরাপত্তা বলয়ের মাধ্যমে বিভিন্ন সংস্থার সদস্যদের সঙ্গে সমন্বয়ের মাধ্যমে গোয়েন্দা নজরদারি এবং এয়ারসাইডের কার্গো এলাকার মালামালের নিরাপত্তা ও সুরক্ষা নিশ্চিত করত।
কিন্তু, ৫ আগস্ট পরবর্তী সময়ে বিমানবন্দরের এয়ারসাইডে বেবিচক কর্তৃক এয়ারপোর্ট এপিবিএনের সব কার্যক্রম বন্ধ করে দেওয়ায় কার্গো এলাকায় সব ধরনের গোয়েন্দা নজরদারি, পেট্রোলিং, নিরাপত্তা প্রদানসংক্রান্ত সব কার্যক্রম বিলুপ্ত হয়ে যায়।
১৮ অক্টোবর (শনিবার) দুপুর ২টা ১৫ মিনিটে আমদানি কার্গো গোডাউনে আগুনের প্রাথমিক ধোঁয়া দেখা যায়, যা পরবর্তীতে পুরো এলাকায় ছড়িয়ে পড়ে। যথার্থ মনিটরিং, পেট্রোলিং, নিরাপত্তার দায়িত্বে নিয়োজিত সদস্যরা সক্রিয় থাকলে দ্রুত এই আগুন নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব হতো। এই সংকট মোকাবিলায় এয়ারপোর্ট এপিবিএন এপ্রোন এলাকায় উদ্ধার কাজে অংশগ্রহণের জন্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে অনুরোধ করলেও তারা অনীহা প্রকাশ করে। পরবর্তীতে এপ্রোন এলাকায় প্রবেশ নিষেধ থাকায় এপিবিএন সদস্যরা আমদানি কার্গো ভিলেজের বাইরের দিক থেকে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে অগ্নিনির্বাপণ ও উদ্ধার কাজে অংশ নেয়। এপিবিএন ও আনসার সদস্যরা তাদের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে কাজ করলেও কর্তব্যরত সদস্যরা প্রায় নিষ্ক্রিয় অবস্থায় ছিল বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়।
এদিকে কার্গো ভিলেজে অগ্নিকাণ্ডের কারণ ও ক্ষয়ক্ষতি নির্ণয়ে এখন পর্যন্ত তিনটি তদন্ত কমিটি গঠিত হয়েছে। এর মধ্যে ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তর গঠিত কমিটি আগুনের কারণ নির্ণয়ের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকায় রয়েছে। জানতে চাইলে ফায়ার সার্ভিসের পরিচালক (অপারেশন ও মেইনটেন্যান্স) এবং তদন্ত কমিটির সভাপতি লে. কর্নেল মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম চৌধুরী যুগান্তরকে বলেন, আগুনের কারণ নির্ণয়ে তদন্ত কার্যক্রম শুরু হয়েছে। সোমবার (২০ অক্টোবর) ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছে কমিটির সদস্যরা। ১৫ কার্যদিবসের মধ্যে প্রতিবেদন জমা দেওয়া হবে।’
উল্লেখ্য, শাহজালাল বিমানবন্দরের অভ্যন্তরে কার্গো ভিলেজে শনিবার (১৮ অক্টোবর) দুপুর শোয়া ২টায় অগ্নিকাণ্ডের সূত্রপাত হয়। খবর পেয়ে একে একে ফায়ার সার্ভিসের ৩৭টি ইউনিট ঘটনাস্থলে গিয়ে আগুন নেভানোর চেষ্টা করে। রাত ৯টা ১৮ মিনিটে আগুন নিয়ন্ত্রণে আসে। তবে আগুন পুরোপুরি নির্বাপণ হয় রোববার বিকাল ৪টা ৫৫ মিনিটে। এর মধ্যে পুড়ে ভস্ম হয়ে ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে কার্গো ভিলেজটি। আগুনে ১২ হাজার কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে বলে জানিয়েছে রপ্তানিকারকদের সংগঠন এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ।
আপনার মতামত লিখুন :