ঢাকা মঙ্গলবার, ০৮ অক্টোবর, ২০২৪, ২৩ আশ্বিন ১৪৩১

ইউনূসের পাশে যুক্তরাষ্ট্র

দৈনিক নতুন সংবাদ | আতিক আকাশ, ঢাকা : সেপ্টেম্বর ১৬, ২০২৪, ০২:১০ এএম ইউনূসের পাশে যুক্তরাষ্ট্র

‘বাকপটুু হিসেবে পরিচিতি নেই তাঁর। প্রয়োজনের তুলনায় কম বলেন কথাও। তবে যতোটুকু বলেন, ততোটুকুই মেদহীন। পোশাক-পরিচ্ছেদে আর চলনে-বলনে তিনি আপাদমস্তকই ‘সরল’। কখনও মুগ্ধতা ছড়ানো সরল হাসিতে, আবার কখনওবা শিশুর মতো ‘কান্নায়’- যে কারোরই দৃষ্টি আকর্ষণের অসম্ভব ক্ষমতা রয়েছে তাঁর। তিনি প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূস, বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা। কর্মগুণে বিশ্বজুড়ে এক নামে পরিচিত শান্তিতে নোবেলজয়ী এই অর্থনীতিবিদই এখন বাংলাদেশের ভরসা । 


গণতন্ত্রের লেবাসে টানা ষোলবছর শেখ হাসিনার ‘পৈশাচিক স্বৈরতন্ত্রের’ যাতাকলে নির্মমভাবে পিষ্ট বাংলাদেশকে টেনে তোলার কঠিনতম দায়িত্ব এখন প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূসের কাঁধে। ছাত্র-জনতার অনুরোধ উপেক্ষা করতে অপারগ হয়ে ৮ আগস্ট অন্তর্বর্তী সরকার প্রধানের দায়িত্ব নেন তিনি। তারুণ্যের শক্তি-সমর্থনকে সঙ্গী করে পঁচাশি বছর বয়সে এসে রাষ্ট্র পরিচালনায় একের পর এক ইতিবাচক চমক দেখিয়ে যাচ্ছেন তিনি। ৫ আগস্ট রক্তসমুদ্রে শেখ হাসিনা সরকারের ঐতিহাসিক পতনের পর দেশে ‘রক্তগঙ্গা’ বয়ে যাওয়ার যে শঙ্কা বিরাজমান ছিল, অত্যন্ত দৃঢ়তার সঙ্গে সেই পরিস্থিতি ভালোভাবেই সামলে নিয়েছেন তিনি। এখন হাত দিয়েছেন রাষ্ট্র সংস্কার আর বৈশ্বিক সম্পর্ক উন্নয়নের কাজে। প্রতিকূল পরিস্থিতিতে ফলও আসছে তাঁর অনুকূলে। তাঁর কারণেই ইতোমধ্যে বিশ্বের প্রবল ক্ষমতাধর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র অকুণ্ঠভাবে সমর্থন যোগাচ্ছে বাংলাদেশকে। শুধু যুক্তরাষ্ট্র নয়, বারাক ওবামাসহ ১৯৮ জন বিশ্বনেতা প্রকাশ্য ঘোষণা দিয়ে সমর্থন যোগাচ্ছেন তাকে।


অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে ৮ আগস্ট শপথ নেন ড. মুহাম্মদ ইউনূস। পরদিন ৯ আগস্টই বাংলাদেশের নতুন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে স্বাগত জানায় যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন। বাংলাদেশে যুক্তরাষ্ট্রের সর্বোচ্চ পদমর্যাদার কূটনীতিক হেলেন লা ফাভে উপদেষ্টাদের শপথ অনুষ্ঠানে যোগ  দেন। গণতন্ত্রকে এগিয়ে নিতে একসঙ্গে কাজ করার বিষয়ে আশা প্রকাশ করে ওয়াশিংটন। যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তরের মুখপাত্র ম্যাথিউ মিলার ৯ আগস্ট সাংবাদিকদের বলেন, ‘সাম্প্রতিক সহিংসতা বন্ধে ড. ইউনূসের আহ্বানকে আমরা স্বাগত জানাচ্ছি। অন্তর্র্বতীকালীন সরকার ও ড. ইউনূস বাংলাদেশের জনগণের জন্য একটি গণতান্ত্রিক ভবিষ্যৎ তৈরি করতে চায়। তাই আমরা অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ও ড. ইউনূসের সঙ্গে কাজ করতে প্রস্তুত রয়েছি।’ 


ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারকে সমর্থন জানায় মার্কিন সিনেটের মেজরিটি হুইপ ডিক ডারবিন। ১০ সেপ্টেম্বর এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়, ‘ওয়াশিংটন ডিসিতে মার্কিন সিনেটে ফ্লোর নিয়ে বাংলাদেশের ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হাতে কয়েক দশক ধরে হয়রানির শিকার হওয়া ড. ইউনূসের প্রতি সমর্থন জানিয়েছে।’


৪ সেপ্টেম্বর ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের প্রতি দৃঢ় সমর্থন জানিয়েছেন ১৯৮ বিশ্বনেতা। তাদের মধ্যে সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামাসহ ৯২ জন নোবেলজয়ী রয়েছেন। যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটন পোস্ট পত্রিকায় বিশ্বনেতাদের বিবৃতিটি পুরো পৃষ্ঠাজুড়ে প্রকাশিত হয়েছে।


ড. মুহাম্মদ ইউনূসের প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থন শুধু বিবৃতিতেই সীমাবদ্ধ নেই। কাজেও এর প্রমাণ মিলতে শুরু করেছে। ইতোমধ্যে বাংলাদেশকে ২০ কোটি ডলারের বেশি উন্নয়ন সহযোগিতা দিচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র। গতকাল রোববার অন্তর্র্বতী সরকারের সঙ্গে ইউনাইটেড স্টেটস এজেন্সি ফর ইন্টারন্যাশনাল ডেভেলপমেন্টের (ইউএসএআইডি) চুক্তি সই হয়েছে। অন্তর্বর্তী সরকার অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে এই চুক্তি সই হয়েছে। স্বাস্থ্য, সুশাসন, মানবিক ও অর্থনৈতিক সুযোগ সৃষ্টি ও মানুষের ঘুরে দাঁড়ানোর সক্ষমতা বৃদ্ধিতে যুক্তরাষ্ট্রের এই অর্থ কাজে লাগানো হবে।


যুক্তরাষ্ট্র মূলত ইউএসএআইডি ও ইউএসডিএর মাধ্যমে উন্নয়ন সহযোগিতা দিয়ে থাকে। ১৯৭৪ সালে স্বাক্ষরিত অর্থনৈতিক প্রযুক্তিগত ও সম্পর্কিত সহায়তা শীর্ষক একটি চুক্তির অধীনে যুক্তরাষ্ট্র গণতন্ত্র, সুশাসন, খাদ্যনিরাপত্তার মতো বিভিন্ন খাতে আজ পর্যন্ত ৮ বিলিয়ন বা ৮০০ কোটি ডলারের বেশি সহায়তা দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র।


এদিকে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস দেশ পুনর্গঠন, গুরুত্বপূর্ণ সংস্কার কর্মসূচি বাস্তবায়ন এবং পাচার হওয়া অর্থ ফিরিয়ে আনতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সহযোগিতা চেয়েছেন।  গতকাল রোববার ঢাকায় রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনায় সফররত উচ্চ পর্যায়ের মার্কিন প্রতিনিধিদলের সঙ্গে এক বৈঠকে প্রধান উপদেষ্টা এ সহায়তা চান।


২০০৬ সালে নোবেল শান্তি বিজয়ী অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস অন্তর্বর্তী সরকারের চ্যালেঞ্জসমূহ উল্লেখ করে বলেন, তার সরকার দ্রুততার সঙ্গে অর্থনীতি পুনর্গঠন, সংস্কার ও পুনরায় সচল করার পাশাপাশি আর্থিক খাতে সংস্কার এবং বিচার বিভাগ ও পুলিশের মতো প্রতিষ্ঠানগুলো কার্যকর করার উদ্যোগ নিয়েছে।


বৈঠকে প্রধান উপদেষ্টা উল্লেখ করেন বর্তমান সময়টি আমাদের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং আমাদের ইতিহাসের এক তাৎপর্যপূর্ণ মুহূর্ত। তিনি ছাত্রদের নেতৃত্বে সংগঠিত বিপ্লব সম্পর্কে বলেন, এই বিপ্লব বাংলাদেশে নতুন আশা জাগানিয়া যুগের সূচনা করেছে।


প্রধান উপদেষ্টা মার্কিন প্রতিনিধিদলের কাছে অন্তর্বর্তী সরকারের গৃহীত সংস্কারের রূপরেখা তুলে ধরে বলেন, তার সরকার দায়িত্ব গ্রহণের মাত্র কয়েক সপ্তাহের মধ্যে ভোট কারচুপি প্রতিরোধে নির্বাচন কমিশন সংস্কার এবং বিচার বিভাগ, পুলিশ, জনপ্রশাসন, দুর্নীতি দমন কমিশন ও সংবিধান সংশোধনের লক্ষে ছয়টি কমিশন গঠন করেছে। স্বৈরাচার সরকারের ঘনিষ্ঠ দুর্নীতিবাজ ব্যক্তিদের দ্বারা আত্মসাৎকৃত ও পাচার হওয়া অর্থ ফিরিয়ে আনার ব্যাপারে সরকার অঙ্গীকারবদ্ধ বলে তিনি উল্লেখ করেন।


অন্তর্বর্তী সরকারকে দুর্নীতির মত বড় চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হচ্ছে উল্লেখ করে বিশ্ববরেণ্য অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক ইউনূস বলেন, ‘আমরা দুর্নীতির এক গভীর সমুদ্রে নিমজ্জিত ছিলাম।’


যুক্তরাষ্ট্রের রাজস্ব ও অর্থ দপ্তরের আন্তর্জাতিক অর্থায়নবিষয়ক সহকারী আন্ডার সেক্রেটারি ব্রেন্ট নেইম্যানের নেতৃত্বাধীন মার্কিন প্রতিনিধিদল অধ্যাপক ইউনূসের নেতৃত্বের প্রশংসা করে বলেন, ওয়াশিংটন অন্তর্বর্তী সরকারের সংস্কার কর্মসূচি বাস্তবায়নে সহায়তা করতে পারলে আনন্দিত হবে। বৈঠকে মার্কিন কর্মকর্তারা জানান, ড. ইউনূস সরকারের বাস্তবায়নাধীন সংস্কার কর্মসূচিতে তারা প্রযুক্তি ও আর্থিক সহায়তা দিতে আগ্রহী।


ঘণ্টাব্যাপী বৈঠকে আর্থিকখাতের সংস্কার, বিনিয়োগ, শ্রম পরিস্থিতি, রোহিঙ্গা সঙ্কট এবং জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনে যোগদান উপলক্ষে প্রধান উপদেষ্টার আসন্ন নিউইয়র্ক সফর নিয়ে আলোচনা হয়। ব্রেন্ট নেইম্যানের নেতৃত্বে মার্কিন প্রতিনিধিদলে আরো ছিলেন যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়াবিষয়ক সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডোনাল্ড লু, যুক্তরাষ্ট্রের সহকারী বাণিজ্য প্রতিনিধি ব্রেন্ডন লিঞ্চ এবং মার্কিন ট্রেজারি ডিপার্টমেন্টের পরিচালক জেরড ম্যাসন।  

অর্থনৈতিক সহায়তার আশ্বাস যুক্তরাষ্ট্রের :


সফররত যুক্তরাষ্ট্রের উচ্চ-পর্যায়ের প্রতিনিধিদল বাংলাদেশের অর্থনৈতিক সুযোগ-সুবিধা সম্প্রসারণ, প্রাতিষ্ঠানিক স¶মতা গড়ে তোলা এবং মানবাধিকার সমুন্নত রাখতে সহায়তার আশ্বাস দিয়েছে। মার্কিন দূতাবাস এ কথা জানিয়েছে।
দূতাবাস বলেছে, ‘আমরা আমাদের অংশীদার বাংলাদেশের সাথে অর্থনৈতিক সুযোগ-সুবিধা সম্প্রসারণ, প্রাতিষ্ঠানিক স¶মতা গড়ে তোলা, মানবাধিকার সমুন্নত রাখা এবং জলবায়ু ঝুঁকি কমিয়ে আনতে সহায়তা করতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।’
রাজধানীর রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন পদ্মায় পররাষ্ট্র উপদেষ্টা মোঃ তৌহিদ হোসেন এবং সফররত প্রতিনিধি দলের মধ্যে বৈঠক শেষে গতকাল দূতাবাস তাদের অফিসিয়াল ফেসবুক পেজে এ কথা জানায়। ###
 

Side banner