ঢাকা রবিবার, ২৮ সেপ্টেম্বর, ২০২৫, ১২ আশ্বিন ১৪৩২

যেভাবে কলকাতা থেকে বাংলাদেশের রাজনীতিতে ফেরার পরিকল্পনা আ.লীগের

দৈনিক নতুন সংবাদ | ডেস্ক রিপোর্ট, ঢাকাঃ সেপ্টেম্বর ২৪, ২০২৫, ০১:০০ পিএম যেভাবে কলকাতা থেকে বাংলাদেশের রাজনীতিতে ফেরার পরিকল্পনা আ.লীগের

দীর্ঘ ১৫ বছরের শাসনের পর গণআন্দোলনের মুখে ক্ষমতা হারানো আওয়ামী লীগ এখন কলকাতা থেকে রাজনৈতিক পুনর্গঠনের চেষ্টা করছে। নিষিদ্ধ ঘোষিত দলটির নেতারা ভারতে নির্বাসিত জীবনযাপন করছেন এবং সেখান থেকেই ফের রাজনীতিতে সক্রিয় হওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছেন। ভারতের সংবাদমাধ্যম Scroll-এ প্রকাশিত এক বিস্তৃত প্রতিবেদনে উঠে এসেছে এসব তথ্য।

প্রতিবেদনে জানানো হয়, আওয়ামী লীগের সাবেক সংসদ সদস্য ও হৃদরোগ বিশেষজ্ঞ ডা. হাবিবে মিল্লাত ২০২৪ সালের অক্টোবরে ছাত্রদের নেতৃত্বে ঢাকায় শুরু হওয়া গণআন্দোলনের সময় সাত সপ্তাহ ঢাকায় লুকিয়ে ছিলেন। পরে সীমান্ত পেরিয়ে কলকাতায় আশ্রয় নেন তিনি। তার ভাষায়, পালিয়ে যাওয়ার সময় তিনি গাড়ি, মোটরসাইকেল ও হেঁটে ২২ ঘণ্টায় সীমান্ত অতিক্রম করেন। কলকাতায় পৌঁছেও শুরুতে চরম দুর্ভোগ পোহাতে হয় তাকে। কোনো অর্থ না থাকায় চার রাত মাটিতে ঘুমাতে হয়েছিল।

হাবিবে মিল্লাত বলেন, ঢাকায় চলমান আন্দোলনের সময় আওয়ামী লীগের বিপুলসংখ্যক নেতাকর্মী নিপীড়নের শিকার হয়েছেন। তার মতে, অন্তত ৬৩৭টি ঘটনায় আওয়ামী লীগ কর্মীরা জনতার হাতে মার খেয়েছেন। এর মধ্যে অনেকেই নিহতও হয়েছেন বলে দাবি করেন তিনি। এছাড়া দলের ১১৬ জন সাবেক সংসদ সদস্য বর্তমানে কারাবন্দি।

ডা. মিল্লাত বর্তমানে কলকাতায় স্ত্রীসহ একটি ভাড়া অ্যাপার্টমেন্টে থাকেন। সেখান থেকেই তিনি দলের হয়ে আন্তর্জাতিক মহলে রাজনৈতিক লবিং চালিয়ে যাচ্ছেন। কানাডাভিত্তিক থিঙ্ক ট্যাঙ্ক গ্লোবাল সেন্টার ফর ডেমোক্রেটিক গভর্নেন্সের সঙ্গে কাজ করছেন তিনি। উদ্দেশ্য, অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার এবং আওয়ামী লীগকে আগামী নির্বাচনে অংশগ্রহণের সুযোগ করে দেওয়া।

প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, শেখ হাসিনা ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট দিল্লিতে যান। এরপর থেকে দলটির কার্যক্রম বাংলাদেশে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়। তবে হাবিবে মিল্লাতসহ শতাধিক নেতা ভারতে পালিয়ে গেছেন। তাদের অনেকেই এখন কলকাতায় অবস্থান করছেন। রাজনৈতিকভাবে পুনর্গঠনের অংশ হিসেবে তারা ভার্চুয়াল বৈঠক করছেন, কলকাতার বিভিন্ন জায়গায় বসছেন, এমনকি সীমান্তপারের কর্মীদের সঙ্গেও নিয়মিত যোগাযোগ রাখছেন।

সম্প্রতি বিবিসির এক প্রতিবেদনে দাবি করা হয়, কলকাতায় আওয়ামী লীগ একটি অফিস খুলেছে। এ নিয়ে বাংলাদেশে তীব্র প্রতিক্রিয়া হয়। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় একে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে স্পষ্ট অবমাননা বলে আখ্যায়িত করে। ভারতের পক্ষ থেকে বলা হয়, বিষয়টি ‘ভুলভাবে উপস্থাপন’ করা হয়েছে।

আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক শফিউল আলম চৌধুরী নাদেল এসব অভিযোগ অস্বীকার করেছেন। তিনি বলেন, ‘যাকে অফিস বলা হচ্ছে, সেটি আসলে একজন ব্যবসায়ীর ব্যক্তিগত জায়গা। আমরা মাঝে মাঝে সেখানে বসি। সেটা অফিস নয়।’ কলকাতার এক শপিং মলের কফিশপে বসেই তিনি এসব কথা বলেন।

নাদেল বর্তমানে কলকাতায় একটি সাধারণ জীবন যাপন করছেন। তিনি বলেন, ‘ব্যাংকে লাইন দিচ্ছি, বাজার করছি, এমনকি রিকশাওয়ালার সঙ্গে ৩০ টাকার জন্য দর কষাকষি করছি। কিন্তু দলের প্রতি আমার আনুগত্য একটুও কমেনি।’

তিনি স্বীকার করেন, যদি অফিস বলতেই হয়, তাহলে অন্তত পাঁচ-ছয়টি জায়গা আছে কলকাতায়, যেখানে তারা বসেন বা যোগাযোগ রক্ষা করেন।

আওয়ামী লীগের একজন ছাত্রনেতা সাদ্দাম হোসেন। বর্তমানে নিউ টাউনে অবস্থান করা এই নেতা বলেন, তিনি প্রতিদিন ভার্চুয়ালি দেশের ছাত্রদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখেন। তার বিরুদ্ধে ঢাকায় একটি হত্যা প্রচেষ্টার মামলাও রয়েছে। তিনি জানান, প্রতিদিনের ক্ষোভ ও আন্দোলনের মধ্য দিয়ে তারা ইউনূস সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টি করছেন।

সাদ্দাম বলেন, সম্প্রতি তার শেখ হাসিনার সঙ্গে দেখা হয়েছে। সেই সাক্ষাৎকে তিনি ‘হৃদয়গ্রাহী’ ও ‘অনুপ্রেরণাদায়ক’ বলে বর্ণনা করেন।

হাবিবে মিল্লাতও আত্মবিশ্বাসী। তিনি মনে করেন, আওয়ামী লীগ যদি নির্বাচনে অংশগ্রহণের সুযোগ পায়, তাহলে তাদের সাংগঠনিক শক্তির মাধ্যমে বড় ধরনের ফলাফল অর্জন সম্ভব।

তবে এ বিষয়ে বিরোধী দলগুলোর অবস্থান একেবারেই বিপরীত। বিএনপি এবং জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) উভয়ই আওয়ামী লীগকে ‘ফ্যাসিস্ট’ আখ্যা দিয়েছে এবং তাদের নির্বাচনে ফেরার সম্ভাবনা একেবারেই উড়িয়ে দিয়েছে। বিএনপির রুহুল কবির রিজভী বলেন, আওয়ামী লীগের অতীত শাসনের জন্য তাদেরকে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি পেতে হবে।

এনসিপি নেতা সারোয়ার তুষার বলেন, আওয়ামী লীগের আর কোনো রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ নেই। জনগণ তাদের ক্ষমা করবে না।

প্রতিবেদনে ভারতের কূটনৈতিক হিসাব-নিকাশও উঠে এসেছে। আওয়ামী লীগ ভারতের দীর্ঘদিনের রাজনৈতিক মিত্র। তবে বিএনপি-জামায়াতের সঙ্গে অতীতে ভারতের সম্পর্ক ভালো ছিল না। ভারতের অনেকেই মনে করেন, সেই জোট ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলে বিচ্ছিন্নতাবাদে উসকানি দিয়েছিল। এ কারণেই ভারতের জন্য আওয়ামী লীগ একটি ‘সহজ’ পছন্দ ছিল।

অবসরপ্রাপ্ত কূটনীতিক বীণা শিকরি বলেন, ভারতের স্বার্থে বাংলাদেশের নির্বাচন হওয়া উচিত ‘সুষ্ঠু, মুক্ত ও অন্তর্ভুক্তিমূলক’।

অন্যদিকে থিঙ্কট্যাঙ্ক অবজারভার রিসার্চ ফাউন্ডেশনের গবেষক আদিত্য গোদারা মনে করেন, শেখ হাসিনাকে ফিরিয়ে আনা বা আওয়ামী লীগকে একেবারে নিষিদ্ধ করে রাখা—দুটোর একটিও ভারতের পক্ষে সহজ সিদ্ধান্ত নয়। তিনি বলেন, ভারতের কাছে এখন গুরুত্বপূর্ণ হলো, পরবর্তী যে দলই ক্ষমতায় আসুক, তাদের সঙ্গে ভারসাম্যমূলক সম্পর্ক বজায় রাখা।

তিনি আরও বলেন, আওয়ামী লীগ যদি ফেরে, সেটি সময়সাপেক্ষ হবে। তবে ফেরার পথ পুরোপুরি বন্ধ হয়ে গেছে—এমন ভাবার সুযোগ নেই।

১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের সময় কলকাতা ছিল আওয়ামী লীগের মূল ঘাঁটি। পাঁচ দশক পর দলটি আবারও সেখান থেকেই ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছে। তবে এবার পথ অনেক কঠিন, রাজনীতি অনেক বেশি জটিল। ভারতের কূটনৈতিক ভূমিকা, অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক চাপ এবং জনমতের পরিবর্তন—সবকিছু মিলিয়ে আওয়ামী লীগের কলকাতা থেকে বাংলাদেশে ফিরে আসার পথ এখনও অনিশ্চিত। 

Side banner