আফগানিস্তানের বাগরাম বিমানঘাঁটি পুনর্দখলের ইচ্ছা প্রকাশ করেছেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। তবে এ পদক্ষেপ নতুন করে আফগান আগ্রাসনের মতো দেখাতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন বর্তমান ও সাবেক মার্কিন কর্মকর্তারা। তাদের মতে, ঘাঁটি পুনর্দখলে অন্তত ১০ হাজারের বেশি সেনা মোতায়েন ও উন্নত বিমান প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা স্থাপন করতে হবে।
লন্ডনে এক সফরে সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে ট্রাম্প বলেন, ‘আমরা সেই ঘাঁটি আবার চাই।’
তিনি দাবি করেন, চীনের কাছাকাছি অবস্থানেই ঘাঁটিটি হওয়ায় এটি যুক্তরাষ্ট্রের জন্য কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ। ‘ওটা চীনের পারমাণবিক অস্ত্র তৈরির জায়গার মাত্র এক ঘণ্টার দূরত্বে,’ মন্তব্য করেন ট্রাম্প।
২০০১ সালের ১১ সেপ্টেম্বরের সন্ত্রাসী হামলার পর প্রায় দুই দশক আফগানিস্তানে অবস্থানকালে বাগরামই ছিল মার্কিন সেনাদের প্রধান ঘাঁটি। সেখানে ফাস্টফুড চেইন বার্গার কিং ও পিজা হাটসহ নানা দোকানপাট ছিল। বিশাল এক কারাগার কমপ্লেক্সও ছিল ঘাঁটির অংশ।
তবে ২০২১ সালে আফগানিস্তান থেকে সেনা প্রত্যাহারের সময় যুক্তরাষ্ট্র ওই ঘাঁটিও ত্যাগ করে।
আফগানিস্তানের রাজধানী কাবুল থেকে প্রায় এক ঘণ্টার দূরত্বে অবস্থিত বাগরাম বিমানঘাঁটি ছিল দুই দশক ধরে যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক কর্মকাণ্ডের প্রধান কেন্দ্র।
সোভিয়েত যুগে নির্মিত এ ঘাঁটিকে মার্কিন সেনারা ব্যবহার করেছিল আফগান যুদ্ধের মূল ঘাঁটি হিসেবে।
২০১২ সালের দিকে এক লাখেরও বেশি মার্কিন সেনা অবস্থান করত সেখানে। বিস্তীর্ণ রানওয়ে, ভারী অবকাঠামো, সামরিক বিমান ওঠানামার সুবিধা, গোয়েন্দা তৎপরতা, লজিস্টিকস—সব মিলিয়ে এটি ছিল এক কথায় ‘মিনি-আমেরিকা’।
একে একে অ্যামেরিকার তিনজন প্রেসিডেন্ট—জর্জ ডব্লিউ বুশ, বারাক ওবামা ও ডোনাল্ড ট্রাম্প সফর করেন এই ঘাঁটিতে। ঘাঁটিটির বড় সুবিধার মধ্যে একটি ছিল এটির বিস্তীর্ণ রানওয়ে।
যার মধ্যে একটি ৩ দশমিক ৬ কিলোমিটার দীর্ঘ। রানওয়েটিতে সহজেই বিশাল আকৃতির সামরিক কার্গো বিমান ওঠা নামা করতে পারে।
ট্রাম্প বারবার বলছেন, বাইডেন প্রশাসনের ২০২১ সালের আফগানিস্তান থেকে যুক্তরাষ্ট্রের সেনা প্রত্যাহার ছিল ‘একটি মারাত্মক ভুল’। তার দাবি, বাগরাম শুধু আফগানিস্তান নয়, চীনকেও নজরদারির আওতায় রাখার একটি শক্ত ঘাঁটি।
যদিও নিজের প্রথম মেয়াদে সব মার্কিন সেনা প্রত্যাহারের বিষয়ে তালেবানের সঙ্গে ‘দোহা চুক্তি’ করেন ট্রাম্প নিজেই। তবে তার দাবি, সেনা প্রত্যাহারের পরও ওয়াশিংটনের নিয়ন্ত্রণেই রাখতে চেয়েছিলেন ঘাঁটিটি।
যুক্তরাষ্ট্রের বর্তমান ও সাবেক প্রতিরক্ষা কর্মকর্তাদের মতে, এটি কোনোভাবেই সহজ নয়। ঘাঁটি পুনর্দখল করতে হলে ১০ হাজারেরও বেশি সেনা পাঠানো লাগবে, লাগবে উন্নত এয়ার ডিফেন্স ব্যবস্থা। এমনকি তালেবান যদি রাজনৈতিক সমঝোতায় রাজি হয়, তাহলেও আইএস ও আল-কায়েদাসহ নানা জঙ্গি গোষ্ঠীর হামলার ঝুঁকি থেকে যাবে।
আফগানিস্তানের তালেবান সরকার অবশ্য ট্রাম্পের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেছে। আফগান পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা বলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্ক হতে পারে অর্থনীতি ও কূটনীতির ভিত্তিতে, কিন্তু আফগানিস্তানের মাটিতে কোনো বিদেশি সেনা ঘাঁটি রাখা হবে না।’
চীন বিষয়টিকে আঞ্চলিক স্থিতিশীলতায় হুমকি হিসেবে দেখছে। দেশটির পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র লিন জিয়ান বলেন, ‘আফগানিস্তানের ভবিষ্যৎ নির্ধারণ করবে আফগান জনগণ।’
প্রকৃতপক্ষে বাগরামের অবস্থান একে এতটা গুরুত্বপূর্ণ করেছে যুক্তরাষ্ট্রের কাছে। এই ঘাঁটি থেকে পুরো এশিয়ার ওপর নজরদারি করা সম্ভব। কারণ মধ্য এশিয়ার এই অঞ্চলের নিয়ন্ত্রণ যে নেবে তার রাজত্বেই থাকবে ইউরেশিয়া।
তবে এবার বাগরামের নিয়ন্ত্রণ নেওয়া আর অতটা সহজ হচ্ছে না ট্রাম্পের জন্য। কেননা মস্কো-বেইজিং-তেহরানের মতো যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিদ্বন্দ্বীরা চাইবে না তাদের ঘাড়ে শত্রুর নিঃশ্বাস পড়ুক।
এদিকে চীন, রাশিয়া, ইরান ও পাকিস্তান যুদ্ধবিধ্বস্ত আফগানিস্তানে কোনো সামরিক ঘাঁটি পুনঃস্থাপনের প্রচেষ্টার বিরোধিতা করেছে। শুক্রবার (২৬ সেপ্টেম্বর) চীনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এক বিবৃতিতে এ তথ্য জানিয়েছে।
বেইজিংয়ে সংবাদ সম্মেলনে চীনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র গুয়ো জিয়াকুন জানান, বৃহস্পতিবার (২৫ সেপ্টেম্বর) নিউইয়র্কে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের ৮০তম অধিবেশনের ফাঁকে চার দেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ও প্রতিনিধিদের মধ্যে আফগানিস্তান বিষয়ে একটি অনানুষ্ঠানিক বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়।
বৈঠক শেষে প্রকাশিত যৌথ বিবৃতিতে বলা হয়, আফগানিস্তানের সার্বভৌমত্ব, স্বাধীনতা ও ভৌগোলিক অখণ্ডতাকে সম্মান জানানো হয়েছে। পাশাপাশি যে দেশগুলো আফগানিস্তানের বর্তমান পরিস্থিতির জন্য দায়ী, তাদের দ্বারা দেশটিতে বা অঞ্চলে পুনরায় সামরিক ঘাঁটি স্থাপনের বিরোধিতা পুনর্ব্যক্ত করা হয়।
বৈঠকে অংশ নেন রাশিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী সের্গেই লাভরভ, ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সাইয়েদ আব্বাস আরাঘচি, চীনের আফগানিস্তানবিষয়ক বিশেষ দূত ইউয়ে শিয়াওয়ং এবং পাকিস্তানের জ্যেষ্ঠ কূটনীতিক উমের সিদ্দিক। বৈঠকের একটি ছবি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এক্স-এ শেয়ার করেন চীনা দূত ইউয়ে শিয়াওয়ং।
গুয়ো জিয়াকুন বলেন, এটি প্রমাণ করে আফগানিস্তানের প্রতিবেশী দেশগুলো তার সার্বভৌমত্ব, স্বাধীনতা ও জাতীয় মর্যাদাকে কতটা সম্মান করে।
অন্যদিকে, ট্রাম্প সতর্ক করে বলেছেন, তালেবান প্রশাসন যদি বাগরাম বিমানঘাঁটি পেন্টাগনের হাতে তুলে না দেয়, তবে খারাপ কিছু ঘটবে।
আপনার মতামত লিখুন :